সমুদ্র ভাসছে প্লাস্টিক। নিজস্ব চিত্র
বেশ কিছুদিন ধরে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ ছবি উঠে আসছে। প্লাস্টিক খেয়ে তিমি, ডলফিন, কচ্ছপের মতো সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু, প্লাস্টিকের প্যাকেট খেয়ে সাত হরিণের মৃত্যু, প্লাস্টিকের প্যাকেটের কারণে পাহাড়ের জল নামার পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, ধস নামা, সমুদ্রতট প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে যাওয়ার মতো নানা ঘটনার কথা আমরা জানতে পারছি। প্লাস্টিক এই মুহূর্তে বিশ্বের সব থেকে ভয়াবহ দূষণকারী পদার্থ। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্লাস্টিকের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের চারপাশে নজর দিলে বিষয়টা বোঝা যায়।
পেট্রোলিয়ামজাত পলিথিন আবিষ্কার হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। বিশ শতক থেকে ধীরে ধীরে নানা ধরনের প্লাস্টিকের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। স্বাধীনতার পরে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলিতে পেট্রোলিয়াম ও পেট্রাকেমিক্যাল শিল্পগুলির উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। পলিইথিলিন, পলিপ্রপিলিন, পলিভিনাইল ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পেট্রাকেমিক্যাল সংস্থাগুলির উৎপাদন ব্যবহার করতে অনুসারী ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। এখন প্রতিটি রাজ্যে এই অনুসারী শিল্পের কারখানার সংখ্যা কম করেও তিন হাজার। এরা কাঁচামাল হিসেবে কিছুটা রিসাইকেল্ড প্লাস্টিক আর কিছু ভার্জিন দানা মিলিয়ে তৈরি করছে লক্ষ লক্ষ প্লাস্টিকের প্যাকেট। এই প্যাকেটের দাম এতই কম আর এগুলি এতই সহজলভ্য যে একেবারে ছোট দোকানদারও বিনামূল্যে দিয়ে দেন। আমরাও বাড়ি নিয়ে এসে ডাস্টবিনে ফেলে দিই। কিন্তু প্লাস্টিক কোনও ভাবেই পচনশীল নয়। আজ যে প্লাস্টিকের প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলছি তা আগামী কয়েক হাজার বছর রয়ে যাবে প্রকৃতির বুকে।
পরিসংখ্যান অনুসারে, শুধু আমাদের রাজ্যেই নথিভুক্ত প্লাস্টিক প্যাকেট ও সংশ্লিষ্ট নানা দ্রব্য তৈরির কারখানার সংখ্যা প্রায় ১৮০০। এ ছাড়া, অলিগলিতে নথিভুক্ত নয় এমন কারখানার সংখ্যা বেশ কয়েক হাজারের মতো। এরা বছরে কয়েক কোটি প্লাস্টিকের প্যাকেট ও আনুষঙ্গিক জিনিস ৈতরি করে। এর থেকে দূষণই সম্ভবত আগামী প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে চলেছে। প্লাস্টিকের অসচেতন ব্যবহারের ফলে গোটা প্রকৃতিই একটি ডাস্টবিনে রূপান্তরিত হচ্ছে। কম দাম, চটজলদি পাওয়া যায় এবং ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া যায়— এই সুবিধার জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহারে আমরা সড়গড় হয়ে উঠেছি। প্রশ্ন ওঠে, এর কি কোনও বিকল্প নেই?
সচেতনতা তৈরি ও সরকারি পদক্ষেপ দু’টিকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। চাকরি সূত্রে বাঁকুড়ায় থাকার সময়ে দেখেছি মুকুটমণিপুরে শুধু শীতে পিকনিকের ফলে যে পরিমাণ থার্মোকলের আবর্জনা জমা হচ্ছে তা পরিষ্কার করতে সরকারের বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে হত। এর পরে সিদ্ধান্ত হয়, কোন পিকনিকের দলকে থার্মোকলের থালা, বাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তার বদলে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে শালপাতার থালাবাটির দোকান খুলতে দেওয়া হল। পিকনিকের দলগুলিকে প্লাস্টিকের থালার বদলে এই শালপাতার থালা ব্যবহার করতে বলা হল। ভাল ফল মেলে। একই ভাবে প্লাস্টিকের বদলে কাগজের ঠোঙা, কাগজের প্যাকেট, কাপড়ের বা চটের থলে, প্লাস্টিকের বোতলের বদলে কাচের বোতল, স্ট্র-এর বদলে গ্লাসে ঢেলে ঠান্ডা পানীয় পান করা— এ ধরনের ছোট ছোট কাজগুলি তো করাই যায়। এর পাশাপাশি, প্লাস্টিকের উৎপাদন কি আমরা বন্ধ করতে পারি না?— এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
আসলে আমরা এখনও প্লাস্টিককে শত্রু বলে ভাবতে শিখিনি। আমাদের দেশে অনেক আইন রয়েছে। দূষণ ছড়াচ্ছে বলে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিকের ছোট ছোট কারখানাগুলি বন্ধ করার কথা ভাবতে পারছি না কেন? কেন প্লাস্টিক শিট তৈরির যন্ত্র যারা তৈরি করে তাদের বলছি না এমন যন্ত্র বানাতে যা দিয়ে চল্লিশ মাইক্রনের কম প্লাস্টিকের শিট বানানো যাবে না? বলছি না, কারণ আমাদের আশু বিপদটা চোখে পড়ছে না। পাশাপাশি, প্লাস্টিকের কারখানাগুলিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের কর্মসংস্থানের প্রশ্নও রয়েছে। তবে এটাও ভাবতে হবে কারখানাগুলি বন্ধ হলে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু তা সাময়িক। প্লাস্টিকের বদলে চট বা কাপড়ের থলির কারখানা খোলা যেতে পারে। যেখানে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের বিষয়েও ভাবা যেতে পারে। যেমন, ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের জিনিস গুঁড়ো করে গলিয়ে তৈরি হতে পারে পেভমেন্ট টাইলস। পিচের সঙ্গে মিশিয়ে রাস্তা তৈরির কাজেও ব্যবহার করা যায়। তৈরি করা যেতে পারে বিল্ডিং ব্লক, যা হাল্কা কিন্তু টেকসই। এর জন্য প্লাস্টিকের বর্জ্যকে যেখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর জন্য পাড়ার মোড়ে মোড়ে বড় বড় ডাস্টবিন বসানো যেতে পারে যেখানে শুধু প্লাস্টিকের জিনিস ফেলা হবে। পরে এই বর্জ্য বিকল্প ব্যবহার করা যেতে পারে। জাপানে এখন এমন কাগজ তৈরি করছে যার ভেতরে গাছের বীজ ছড়ানো থাকছে। যাতে পরিত্যক্ত কাগজ যেখানেই পড়ুক, সেখান থেকে নতুন গাছ জন্মাতে পারে। যেহেতু গাছ কেটে কাগজ তৈরি হয় তাই কাগজের মাধ্যমে গাছের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে নতুন গাছের সৃষ্টিতে কিছুটা সাহায্য করা। শিক্ষার কোনও সময় হয় না, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা সবাই শিখে চলি। এও এক শিক্ষা যা একটু দেরিতে হলেও আমরা শিখে নিতে পারি আর এতে আমরা বাঁচব আর বাঁচাবো আগামী পৃথিবীকে।
লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটীরশিল্প দফতরের যুগ্ম আধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy