Advertisement
E-Paper

মাটি বাঁচালে বাস্তুতন্ত্র বাঁচবে

অবৈধ জেনেও মাটির জন্য দেদার কাটা হচ্ছে নদীর পাড়। টাকার জন্য অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাটি কেটে জমির ক্ষতি করে, পরিবেশ ধ্বংস না করে, বেশি করে গাছ লাগিয়ে তাকে রক্ষা করতে হবে। তবেই বাঁচবে প্রকৃতি আর বাঁচব আমরাও। মাটিকে রক্ষার কথা লিখছেন সুদীপ ভট্টাচার্যটাকা যে তাঁর কাছে কতটা মূল্যহীন তা বোঝাতে গিয়ে শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, টাকা মাটি, মাটি টাকা। 

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:০৬
Share
Save

টাকা যে তাঁর কাছে কতটা মূল্যহীন তা বোঝাতে গিয়ে শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, টাকা মাটি, মাটি টাকা।

আজ কিন্তু পরিস্থিতি উল্টো। এখন অনায়াসেই বলা যায়, মাটিই টাকা, টাকাই মাটি। টাকার জন্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে চাষের জমির মাটি। অবৈধ জেনেও মাটির জন্য দেদার কাটা হচ্ছে নদীর পাড়। এক বিঘা চাষের জমি দুই ফুট গভীর করে কেটে মাটি বিক্রি করলেই পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকা পকেটে আসছে জমি মালিকের।

এক বিঘা জমিতে দু’ফুট মাটি কাটলে গড়ে প্রায় ২০০ ট্রাক্টর মাটি পাওয়া যায়। যা ট্রাক্টর পিছু কম বেশি ৬০০ টাকা করে বিক্রি হয়ে যায় ইটভাটায় ইট তৈরি, নিচু জমি ভরাট করা বা বাড়ি তৈরির সময়ে জমি ভরাটের মতো নানা প্রয়োজনে। ইট তৈরির জন্য চাষের জমির মাটির চাহিদা সব চেয়ে বেশি। যদিও চাষের জমির মাটি কাটলে সে জমিতে তার পর আর ফসল ভাল হয় না বলে, টাকার খুব প্রয়োজন না পড়লে ফসলি জমির মাটি সাধারণত বেচতে চান না চাষি। বরং আশেপাশের জমির থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি কেটে সমান করতে বা নিচু জমি যেখানে চাষ হয় না, হলেও ফসল ভাল হয় না। বর্ষায় জল জমে কিংবা নদীর বা রাস্তার ধারের খাস জমি, যা চাষির দখলে আছে, সে সব জমির মাটি বেআইনি ভাবে বিক্রি করে দেন জমির মালিকেরা। খুব নিচু চাষের অযোগ্য জমিগুলোকে মাছ চাষের উপযোগী পুকুর তৈরি করতেও সেখানকার মাটি কেটে বিক্রি করেন জমি মালিকেরা।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই পুরো প্রক্রিয়াটাই চলে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে। বিঘা তিনেক একটা জমিতে ৭ ফুট গভীর করে পুকুর কেটে, পুকুর কাটা মাটি দিয়ে পুকুরের পাড় ৩ ফুট মতো উঁচু করে বাধিয়ে দিয়েও জমির মালিককে প্রায় লক্ষ টাকা দেন মাটি কারবারিরা। মালিকের পুকুর কাটানোও হল, টাকাও মিলল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জমি থেকে মাটি কেটে, ইটভাটা বা অন্য কোনও জায়গায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিন হাত ঘুরে কাজটা শেষ হয়। প্রথমে জমির মালিক এক জনকে মাটি বেচে দেয়। সে পে লোডার দিয়ে মাটি কাটায়। আর এক জন সেই মাটি ইটভাটায় নিয়ে যায় ট্রাক্টর করে।

শহরাঞ্চলে বাড়ি তৈরির সময়ে ভিতের মাঝের অংশ ভরাট করতে সাদা বালির দরকার পড়ে। সেই বালি আসে গঙ্গার মাঝখানে পড়া চর বা গঙ্গার ধারের সেই সব এলাকা, যেখানকার মাটিতে প্রচুর পরিমাণে সাদা বালি আছে সেখান থেকে। এই বালির দাম চাষের জমির মাটির থেকে কিছুটা বেশি। আনা-নেওয়ার রাস্তায় বিপদ বলতে প্রধানত থানার পুলিশ। সেখানে বেআইনি ভাবে টাকা দিয়ে (স্থানীয় ভাষায় মান্থলি) অবাধে চলে মাটির কারবার। এক এক থানায় এক এক রকম মান্থলি। কোথাও ট্রাক্টর প্রতি মাসে ৫০০ টাকা, কোথাও ১০০০ টাকা দিতে হয় স্থানীয় থানাকে। মাঝে মাঝে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর থেকে বিশেষ অভিযান হলে ধরা পড়লে ফাইন হয়।

আইন মেনে মাটি কাটার কিছু নিয়ম আছে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে নদীর পাড় থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত নদী পাড়ের মাটি কাটা নিষিদ্ধ। সরকারি অনুমতি নিয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কৃষি বা ভিটে জমি থেকে দেড় ফুটের মতো মাটি কাটাতে পারেন জমির মালিক। তবে সেই মাটি বিক্রি করতে গেলে সরকারকে নিয়ম মেনে রাজস্ব দিয়ে তবেই বেচা যাবে। পুকুর কাটার ক্ষেত্রে আগে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে তাকে ‘পুকুর’ নামে নথিভুক্ত করে, তারপর মাটি কাটার অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া মাটি কাটলে The mines and minerals (development and regulation) act 1957-এর ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বেআইনি ভাবে মাটি কাটা, বহন করা বা সঞ্চয় করার অপরাধে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দুটোই একসঙ্গে হতে পারে।

মাটি কাটার ফলে প্রকৃতি কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে হুগলি মহসিন কলেজের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মাটি পৃথিবীর এক অমূল্য সম্পদ। তা তৈরি হতেও বহু বছর সময় লেগে যায়।’’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘পাথর ভেঙে বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক আর জৈবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তিন সেন্টিমিটার পুরু মাটির স্তর হতে প্রায় হাজার বছর সময় লেগে যায়। অথচ, পৃথিবীব্যাপী আবহাওয়ার পরিবর্তন-সহ নানা কারণে মাটির স্বাভাবিক ক্ষয় ক্রমশ বাড়ছে। তাই মাটির সংরক্ষণ ও ভূমিক্ষয় রোধের চেষ্টা ভীষণ জরুরি।’’

আমাদের জীবনের প্রধান তিনটে শর্ত অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সব কিছুর উৎপত্তি স্থল মাটি। ভূপৃষ্ঠের মাটিতে ৫০% কঠিন, বাকি ৫০% তরল ও গ্যাসীয় উপাদান আছে। এই ৫০% কঠিন পদার্থের মধ্যে ৪৫% খনিজ পদার্থ ও ৫% জৈবিক পদার্থ থাকে। উপরের দিকের মাটিতে জৈবিক পদার্থ বেশি, নীচের দিকের মাটিতে খনিজ পদার্থ। ভূপৃষ্ঠের মাটিকে উপর থেকে নীচ বরাবর A, B, C এই তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। কোন স্তর কতটা পুরু হবে তা নির্ভর করে কোন পাথর থেকে মাটি তৈরি হয়েছে। সেখানকার জলবায়ু কেমন। কত সময় ধরে মাটি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে— এমন আরও বেশ কিছু কারণের উপরে। A স্তরের ওপরের দিকের স্তর কে O স্তর বলা হয়। O স্তর সজীব ও নির্জীব নানা জৈব পদার্থে পূর্ণ। রং কালচে ধরনের। একে টপ সয়েল বলে। O অংশেই অসংখ্য অণুজীবের বাস।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে উপযুক্ত পরিবেশের এক চা চামচ মাটিতে যা অণুজীব বাস করে তার পরিমাণ সারা পৃথিবীতে বসবাসকারি মানুষের সংখ্যার চেয়েও বেশি। এই অণুজীবেরা মাটিতে কার্বন ধরে রেখে কার্বন চক্রের নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আমাদের ব্যবহারের বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিকও তৈরি হয় এই অণুজীব থেকেই। B স্তরের মাটি, যা সাব সয়েল নামে পরিচিত, তা নানা খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। বড় বড় গাছ তাদের প্রয়োজনীয় খনিজ B স্তর থেকেও সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু ধান, পাট, গমের মতো বেশির ভাগ শস্য জাতীয় ফসলের শিকড় মোটামুটি ভাবে ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত মাটির গভীরে বিস্তৃত হয়। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য মাটির একেবারে উপরের অংশ থেকেই সংগ্রহ করে থাকে তারা। জমিতে দেওয়া সার মাটির উপরের কয়েক ইঞ্চি অংশের মধ্যেই সাধারণত জমা হয়।

তাই চাষের জমির মাটি একটু গভীর করে কেটে জমি থেকে তুলে ফেললে, শস্য জাতীয় গাছের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যও মাটির সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। ফলে নীচের দিকে যে মাটি পড়ে থাকে তাতে খাদ্যাভাবে ভাল ফসল হয় না। নদীর পাড়ের মাটিতে ক্লে মিনারেল বেশি থাকে। যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম দানার, আঠালো প্রকৃতির। এদের জল ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি। ফলে নদী পাড়কে দৃঢ়তা দেয় এই মাটি। নদী পাড়ের এই মাটি কাটলে, তার পিছনের নরম মাটি ধসে গিয়ে নদী ভাঙনের আশঙ্কা তৈরি হয়, নদীর গতিপথেরও পরিবর্তন হতে পারে। নদীর পাড় থেকে চাষের জমি সর্বত্রই মাটিতে ছোট-বড় নানা ধরনের কীট, পতঙ্গ, জীব, জন্তু, পাখি তাদের বাসস্থান গড়ে তোলে। মাটি কাটলে তারা গৃহহীন হয়ে পড়ে। জীব বৈচিত্র নষ্ট হয়। বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন হয়।

কৃষ্ণনগরের রাষ্ট্রীয় উদ্যান গবেষনা কেন্দ্রের প্রাক্তন প্রধান তথা উদ্যানবিদ ব্যাসদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জমিতে দীর্ঘদিন চাষের ফলে গাছের শিকড় থেকে এক ধরনের টক্সিন বেরিয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট করে। জমিকে একটুও বিশ্রাম না দিয়ে সারা বছর রাসায়নিক সার ব্যবহার করে, অবিরাম চাষ করার ফলেও কৃষিজমি এখন দ্রুত উর্বরতা হারাচ্ছে। তবে তার মানে এই নয় যে, সেই অনুর্বর জমির মাটি কেটে ফেলে দিতে হবে জমি থেকে। তা করলে উল্টে জমির ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। জমির এই অনুর্বরতা সাময়িক।’’ তিনি জানান, এই ক্ষেত্রে জমিকে একটা চাষ দিয়ে মাটি ওলটপালট করে, সেই জমিকে কিছুদিন ফেলে রাখলে মাটির হারানো উর্বরতা ফিরে আসবে। কেউ যদি কোনও কারণে জমি থেকে মাটি কেটে, কাটা মাটি স্থানান্তরিত করেন, সে ক্ষেত্রেও একই ভাবে মাটি কেটে নেওয়া জমিকে বেশ কিছু দিন ফেলে রাখলে উর্বরতা ফিরবে। ফেলে রাখার সময়ে জমিতে পরিমাণমতো জৈব সার মেশালে ভাল ফল মিলবে। এক বার শিম্বী গোত্রীয় উদ্ভিদের যেমন ধৈঞ্চা, শন, বিভিন্ন ডাল শস্যের চাষ করে সেই গাছগুলোকে লাঙল দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়বে। অণুজীবের পরিমাণও বাড়বে। ভূমিক্ষয় রোধ করার জন্য ব্যাসদেবের পরামর্শ, ‘‘বেশি করে গাছ লাগান। গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রাখে।’’

এখন নদীর ঢালু পাড়ে ভেটিভার ঘাস লাগানো হচ্ছে, যা মাটিকে ধরে রেখে ভূমিক্ষয় রোধ করে। নদী ভাঙন প্রতিরোধ করে।

টাকার জন্য অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাটি কেটে জমির ক্ষতি করে, পরিবেশ ধ্বংস না করে, বেশি করে গাছ লাগিয়ে তাকে রক্ষা করতে হবে। তবেই বাঁচবে প্রকৃতি আর বাঁচব আমরাও।

Soil Ecosystem

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}