পরের উপকার করিবার বাসনা কেহ প্রকাশ করিলে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রশ্ন করিতেন, নিজের উপকার কি তবে হইয়া গিয়াছে? নিজের উপকার, অর্থাৎ নিজের প্রস্তুতি। দারিদ্র ঘুচাইতে আগ্রহী নেতারা এই উপদেশটি মনে রাখিলে ভাল। উন্নয়নের ভ্রান্ত নীতির জন্য যে অপচয়, তাহা দুর্নীতি কিংবা যুদ্ধাস্ত্রের ব্যয়কেও ছাড়াইতে পারে। অতএব জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গাঁধীর প্রস্তাবিত ‘ন্যায়’ (ন্যূনতম আয় নিশ্চয়তা প্রকল্প) লইয়া বিচার প্রয়োজন। ইস্তাহারে রাহুলের প্রস্তাব, দরিদ্র পরিবারগুলির আনুমানিক বিশ শতাংশকে মাসে ছয় হাজার টাকার অনুদান। ইহাতে ভোটযুদ্ধে কংগ্রেসের ভাল হইবে না মন্দ, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু প্রস্তাবটি ‘ভাল’ কি? সে বিষয়ে সন্দেহ ঘোচে নাই। প্রথম প্রশ্ন, ‘ন্যায়’ রূপায়ণ করিবার অর্থ আসিবে কোথা হইতে? কর্মসৃষ্টি, শিক্ষা, পুষ্টি, ভর্তুকি, সামাজিক সুরক্ষার বিবিধ প্রকল্পের সবই কি বজায় থাকিবে? না কি, কংগ্রেস ক্ষমতায় আসিলে দরিদ্রের সকল প্রাপ্য বজায় রাখিয়া, কর ছাড়ে কোপ ফেলিবে? কংগ্রেস তাহার উত্তর এড়াইতেছে। কিন্তু এই নীরবতা ভোটদাতার সহিত ছলনা। মোদীকে ‘জাদুকর’ বলিয়া বিদ্রুপ করিয়া থাকেন রাহুল। কিন্তু তাক লাগাইবার চেষ্টা কি রাহুলও করিলেন না? উপায় না জানাইলে ভোটদাতার পক্ষে বোঝা সম্ভব নহে, নীতিটি প্রার্থিত না কি পরিত্যাজ্য। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা প্রকাশ করিলে কংগ্রেসের ঝুঁকি হয়তো বাড়িত, কিন্তু স্বচ্ছতর চিন্তাভাবনা ও তাহার অনুসারী রাজনীতির সন্ধান মিলিত। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে যাহা মেলে নাই। বিরোধী দল বিকল্প রাজনীতি করিতে পারে না— ইহা গণতান্ত্রিক ভারতের দুর্ভাগ্য।
দ্বিতীয়ত, বৎসরে বাহাত্তর হাজার টাকা দরিদ্রের নিকট অমূল্য সম্পদ। দরিদ্র পরিবারগুলির আশি শতাংশ তাহাতে বঞ্চিত হইলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হইবে না কি? অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, সরকারি অনুদান-ভর্তুকি প্রকৃত দরিদ্রের নিকট পৌঁছাইবার পূর্বে তুলনায় সম্পন্ন, প্রভাবশালীর হস্তগত হয়। তালিকার ‘ত্রুটি’ লইয়া শোরগোল চলিতে চলিতে ফের নির্বাচন আসিয়া যায়। ‘বিপিএল’ (দারিদ্র সীমার নীচে) তালিকা লইয়া অনেক দিন অবধি যে কুৎসিত রাজনীতি ঘটিত, বিবিধ সরকারি সুবিধা সর্বজনীন করিবার ফলে তাহা কিছুটা প্রশমিত হইয়াছিল। এই কারণেই সম্প্রতি একাধিক বিশেষজ্ঞ ‘সর্বজনীন ন্যূনতম আয়’ প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়াছিলেন। রাহুল ফের দরিদ্র বাছিবার বিধি কার্যকর করিতে চাহেন। ‘নিশানা’-নির্ধারিত উন্নয়নের মডেল ফিরিতে দেখিয়া দরিদ্র পুলকিত হইবে কেন? সর্বোপরি, দরিদ্র বাছিতে গ্রাম উজাড় না করিয়া, সবার জন্য পুষ্টি, চিকিৎসা, জল-বিদ্যুতের পরিকাঠামোয় উন্নতির বিশেষ প্রয়োজন। কর্মী ও বরাদ্দের অভাবে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা নীরক্ত, বলহীন। কৃষি সহায়ক হইতে নার্স-চিকিৎসক, থানার পুলিশ হইতে আদালতের বিচারক, কলেজের অধ্যাপক হইতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক— সর্ব ক্ষেত্রে শূন্য পদের প্রাচুর্য দরিদ্রকে বিপন্ন করিতেছে। একটি হিসাবে, কেবল কেন্দ্রীয় সরকারেই কর্মীদের শূন্য পদের সংখ্যা চব্বিশ লক্ষ। রাজ্য সরকারগুলিতে আরও কত, আন্দাজ করা যাইতে পারে।
দ্রুত ও দুর্নীতিমুক্ত পরিষেবা সকল নাগরিকের সক্ষমতা বাড়াইবে, কিন্তু তাহার ফলে সর্বাধিক লাভবান হইবেন দরিদ্রেরা। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের সরকারি প্রকল্পে নিযুক্ত ‘স্বেচ্ছাসেবী’ কর্মীদের যথাযথ বেতন দিবার অঙ্গীকারও একাধারে সামাজিক ন্যায় এবং আর্থিক ক্ষমতা নিশ্চিত করিবে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়াইলে দরিদ্রের অধিকারের মর্যাদা বাড়িবে। সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য পেনশন, হাসপাতালে সুলভ ঔষধ, এইগুলিও দারিদ্রের প্রকোপ কমাইবে। অতএব ন্যূনতম আয় প্রকল্প দারিদ্র নিরসনের সর্বোত্তম উপায় কি না, তাহার বিচার আবশ্যক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy