Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Vladimir Lenin

কী করিতে হইবে

শারীরিক সক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছাইয়া তিনি যে ‘টেস্টামেন্ট’ তৈয়ারি করিয়া গিয়াছিলেন, তাহার অন্যতম নির্দেশ ছিল: স্তালিনকে অপসারণ করো।

লেনিন। ছবি: সংগৃহীত

লেনিন। ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২০ ০০:৩৯
Share: Save:

আড়াই বছর আগে বলশেভিক বিপ্লবের শতবার্ষিকী অতিবাহিত হইয়াছে। গত বুধবার, অতিক্রান্ত হইল লেনিনের জন্মের সার্ধশতবর্ষ। তাঁহার দুর্ভাগ্য— ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সিংহাসন হইতে কমরেডরা বিদায় হইয়াছেন। তাহা না হইলে, সন্দেহ নাই, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র নেতৃত্বে মহানগরীতে মহা ধুমধাম, মহা হট্টগোল চলিত, ব্রিগেডে মহাসমাবেশের মাচা বাঁধা হইত, ইনকিলাব জিন্দাবাদের আর্তনাদে কলিকাতায় কাক-চিল বসিতে পারিত না। স্বদেশে লেনিনের মূর্তি এবং মতবাদ উৎখাত হইয়াছিল অনেক আগেই, তাহার অভিঘাতে ‘সমাজতান্ত্রিক’ পূর্ব ইউরোপও অচিরেই মুক্তিলাভ করিয়াছিল, কিন্তু তাহার পরেও দীর্ঘ দুই দশক বামফ্রন্ট সরকারের অধীনস্থ এই সুদূর বঙ্গভূমিতে তিনি লাল সেলাম পাইয়াছেন। দেড় শত বৎসরের পূর্তিলগ্নে রাজ্যের সুপ্রবীণ বাম নায়করা হয়তো তাঁহার আলোকচিত্রের সামনে দাঁড়াইয়া অস্ফুট উচ্চারণে বলিয়াছেন: তে হি নো দিবসা গতাঃ। তবে লেনিন নিজে সেই আক্ষেপের শরিক হইতেন না। তাঁহার অনুগামী বলিয়া নিজেদের জাহির করিয়া কাজে তাঁহার চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিবার প্রবণতা তিনি আপন জীবৎকালেই দেখিয়া গিয়াছেন, যে প্রবণতা তাঁহার মৃত্যুর পরে উত্তরোত্তর প্রকট হয় এবং অচিরেই বিকট মূর্তি ধারণ করে। সেই মূর্তির নাম, অবশ্যই, জোসেফ স্তালিন। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ‘সরকারি’ বামপন্থীদের কীর্তিকলাপ সেই তুলনায় অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু তাঁহাদের চিন্তা ও আচরণের মৌলিক চরিত্রটি স্তালিনের ছাঁচে ঢালা। সেই কারণেই তাঁহাদের রাজ্যপাট হারাইবার ব্যথায় লেনিনের সমব্যথী হইবার কোনও কারণ নাই। ভুলিলে চলিবে না, শারীরিক সক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছাইয়া তিনি যে ‘টেস্টামেন্ট’ তৈয়ারি করিয়া গিয়াছিলেন, তাহার অন্যতম নির্দেশ ছিল: স্তালিনকে অপসারণ করো।

এই নির্দেশের মূলে ছিল রাজনৈতিক মত এবং পথের স্বাতন্ত্র। এই প্রসঙ্গটিতে স্তালিন ব্যক্তিমাত্র নহেন, তিনি একটি ধারার (অন্যতম প্রধান প্রবর্তক এবং) প্রতীক, যে ধারা সমাজতন্ত্রের নামে এক সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদকে কায়েম করিতে তৎপর। এই ধারাটিই গত শতাব্দীর এক বড় অংশ জুড়িয়া দুনিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজত্ব করিয়াছে, যে রাজত্ব উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রে পর্যবসিত হইয়াছে। লেনিন সেই পরিণতির ঐতিহাসিক দায় এড়াইতে পারেন না। তাঁহার বিপ্লবের ধারণায় এবং বিপ্লব-উত্তর দেশে পার্টির শাসন জারি রাখিবার জন্য তাঁহার অনুসৃত কর্মপন্থায় পরবর্তী অ-গণতন্ত্রের বীজ নিহিত ছিল। কিন্তু ইহাও ঐতিহাসিক সত্য যে, তিনি নিজে এই বিপদ সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় সচেতন ও সজাগ ছিলেন। জীবনসায়াহ্নের ওই টেস্টামেন্টে তাঁহার নির্দেশ ছিল, পার্টির নেতৃত্ব যাহাতে সদস্যদের, বিশেষত শ্রমিক-কর্মীদের কথা শুনিতে দায়বদ্ধ থাকে, পার্টির কাঠামোতেই যেন তাহা নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র আদর্শ সৎ ভাবে পালনীয়, দলনায়কদের মত দলের উপর চাপাইয়া দিবার অসৎ কৌশল নহে। কমিউনিস্ট পার্টি এবং গণতন্ত্রের মধ্যে যে দূরত্বকে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস কার্যত অলঙ্ঘ্য বলিয়া চিনিয়াছে, লেনিন তাঁহার চেতনার শেষ অবধি তাহাকে অতিক্রম করিবার লক্ষ্য পরিত্যাগ করেন নাই।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রান্তে দাঁড়াইয়া এই ইতিহাস বিচার করিবার প্রয়োজন আছে। লেনিন বা সোভিয়েট ইউনিয়নকে স্মরণের জন্য নহে, কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের চর্চার জন্যও নহে, বিশ্বের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলায় নূতন পথ খুঁজিবার জন্য। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তাহার অনুগামী সামাজিক কাঠামো দুনিয়ায় আধিপত্য করিতেছে, বিশেষত গত তিন দশকে যাহার প্রসার প্রায় সম্পূর্ণ, তাহার সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা এই মুহূর্তে অতিমাত্রায় প্রকট। ভাইরাসের সংক্রমণ সেই সঙ্কটকে এক অভূতপূর্ব রূপ দিয়াছে, কিন্তু সঙ্কটের মূল বিশ্বব্যবস্থার কাঠামোয় নিহিত। চিরাচরিত পন্থায়, প্রচলিত কাঠামোটির অল্পবিস্তর প্রসাধন বা পরিমার্জন করিয়া উত্তরণের পথ মিলিবে, এমন ভরসা আজ আর নাই। আবার, সমাজতন্ত্রের পরিচিত ছকেও সেই পথ মিলিবে না, কারণ— ইতিহাস সাক্ষী— তাহা একটি অ-গণতান্ত্রিক কানাগলি। একই ভুল পথে দুই বার হাঁটিতে নাই— ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভের এই প্রাথমিক শিক্ষা আজও মূল্যবান। দল এবং মত নির্বিশেষে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE