Advertisement
০১ জানুয়ারি ২০২৫
Amartya Sen

চক্রব্যূহ

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:০৫
Share: Save:

দুর্জনের ছলের, দুরভিপ্রায়ীর কৌশলের অভাব হয় না, বঙ্গের চিরায়ত প্রবাদ। সুযোগ বুঝিয়া গুরুতর বিষয়কে ঢাকাচাপা দেওয়া, বিষয়ান্তরে হাওয়া ঘুরাইয়া দেওয়া, কিংবা লঘুকে গুরু করিয়া দেখাইবার চেষ্টা সেই দুরভিসন্ধিরই কৌশল। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে লইয়া বিজেপি যাহা শুরু করিয়াছে, তাহাতে সেই কৌশল ছাড়া কিছু নাই। জনমুখী, বাস্তবমুখী মেধাজীবী, পণ্ডিত অর্থনীতিবিদ হিসাবে তাঁহার সম্মান বা গুরুত্ব বিজেপি কোনও কালেই দেয় নাই। দলীয় নেতা-মন্ত্রী হইতে সমর্থক পর্যন্ত এত কাল তাঁহার বিরুদ্ধে কদর্য কুভাষিত ছড়াইয়া গিয়াছেন। কিন্তু বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে কাজে লাগাইয়া যাহা শুরু হইয়াছে, তাহা অভাবিতের পর্যায়ে। বর্ষীয়ান আশ্রমিকের বাড়ি, জমি ও সংলগ্ন রাস্তা লইয়া ঝঞ্ঝাট তৈরি করা হইতেছে, প্রচার করা হইতেছে, তিনি নাকি অন্যায্য ভাবে বিশ্বভারতীর জমি দখল করিয়া আছেন। অধ্যাপক সেন যথাযথ যুক্তি ও প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও যদি কোনও প্রশ্ন থাকে, আইনের পথেই তাহার মীমাংসা হওয়া সম্ভব। সে পথে হাঁটিতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অনীহায় সংশয় হয়, বিষয়টি কোনও মতেই না মিটাইয়া কেবল কী ভাবে আরও জিয়াইয়া রাখা যায়, ক্রমশ জটিল ও উত্তেজনাময় করিয়া তোলা যায়, সেই দিকেই তাঁহাদের মনোযোগ। বিশ্বভারতীর বিজেপি-প্রভাবিত কর্তৃপক্ষ এত দিনে তাঁহাদের অবস্থান ও মতাদর্শ যথেষ্ট প্রমাণ করিয়াছেন, সুতরাং অমর্ত্য সেনের বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার উপায় নাই। বর্তমান সরকারের কর্মপন্থা সম্পর্কে অবহিত যে কেহই এই অভিসন্ধিপরায়ণ, প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি কৌশলের সহিত পরিচিত— এই দল ও সরকারের যে কোনও নীতি বা নীতিহীনতার সমালোচনা করিলে এইরূপ প্রত্যাঘাতই আসিয়া থাকে।

এই অন্যায় রাজনীতি যে ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে কত বড় দুর্গ্রহ তাহা আর নূতন করিয়া বলিবার দরকার নাই। তবে অমর্ত্য সেনের ঘটনার প্রধান গুরুত্ব অন্যত্র। ইহা সার্বিক ভাবে বাংলা ও বাঙালির শিকড়ে কুঠারাঘাত। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ হইতে শুরু করিয়া আজিকার যুগেও বাঙালির গর্ব করিবার যে নিরবচ্ছিন্ন ও পুষ্ট প্রজ্ঞাপ্রবাহ, অমর্ত্য সেন তাহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বঙ্গবাসীর এই গর্বের মর্মমূলেই বারংবার আঘাত করিবার কৌশল লইয়াছে বিজেপি। অন্তরসম্পদে যাহাকে অতিক্রম করা যাইতেছে না, বহিরঙ্গে তাহাকে ক্রমাগত আঘাত করিয়া, ন্যুব্জ ও হতবল করিয়া জয় করিবার মরিয়া চেষ্টা। এই আঘাত শুধু মনীষীদের উপরেই নহে, সাম্প্রতিক কালে প্রশাসন হইতে শুরু করিয়া সর্ব ক্ষেত্রের দক্ষ ও গুণান্বিত বাঙালির উপর নামিয়া আসিয়াছে। বাঙালির জাতি-পরিচয়ের উপর, তাহার ঔদার্য, সৎসাহস ও আধুনিকতার পরম্পরার উপর ইহা এক সুপরিকল্পিত কুচক্রী আক্রমণ। এই পরিকল্পনায় অমর্ত্য সেন, বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রনাথ, বাঙালির এই তিন ‘আইকন’ই যে আলাদা করিয়া আক্রমণের লক্ষ্য, তাহা এখন দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। তাহা না হইলে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ক্রমাগত শতাব্দীপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ও আশ্রমে একের পর এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি করিতেন না। লঘু সমস্যাকে সময়ে ও সুষ্ঠু উপায়েই মিটাইয়া ফেলিতেন। তিলমাত্র অভিযোগকে আস্ফালনে তালপ্রমাণ করিয়া তুলিবার কারণ ছিল না। সহজ পথে না যাইয়া যখন নোবেলজয়ী অধ্যাপককে কাঠগড়ায় তুলিবার বন্দোবস্ত পাকা করা হয়, এবং তাঁহার ব্যক্তিগত জীবন লইয়া কাটাছেঁড়া শুরু হয়, তখন বুঝিতে হইবে, যূথবদ্ধ চক্রব্যূহে তাঁহাকে আটকাইবার প্রস্তুতিটি পূর্বচিন্তিত— আজিকার নহে। আশা থাকিল, বঙ্গবাসী এই জাতিগর্বের মূলে আঘাতের নীল নকশাটি বুঝিতেছেন। সময়নির্বাচনটিও বুঝিতেছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন আসিতেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Amartya Sen Visva Bharati
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy