তিয়াত্তর বছরের এক বৃদ্ধা ওষুধ কিনতে গেলেন হ্যালোউইনের পর দিন। প্রত্যহ দশ রকম ওষুধ খেতে হয় তাঁকে। তাঁর রক্তচাপের সমস্যা, পেটের সমস্যা, হার্টের অসুখ ইত্যাদি আছে। সব মিলিয়ে অনেক টাকার ধাক্কা। প্রায় চোদ্দোশো ডলার। কিন্তু এ বার তাঁর ওষুধ কেনা হল না। ‘মেডিকেয়ার’ (জাতীয় স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানি) তাঁর ব্যাঙ্ক কার্ড গ্রহণ করতে রাজি নয়। ‘ওয়ালগ্রিন’ ফার্মেসি তাঁকে জানিয়ে দিল, তিনি ওষুধ পাবেন না। কারণ তিনি বেঁচে নেই।
ম্যাগনোলিয়ার (টেক্সাস) বাসিন্দা শেরি এলিসের পা টলে গেল। তিনি জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছেন। নিজেই নিজের ওষুধ নিতে এসেছেন। অথচ এঁরা বলছেন, তিনি মৃত? কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। অনুরোধ জানালেন, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা হোক। ফার্মেসির লোকজনের হেলদোল নেই। যতই তিনি সশরীরে তাঁদের সামনে উপস্থিত হন, কার্ড নম্বর বলছে, তিনি জীবিত নন, মৃত। হতভম্ব শেরি অনেক ফোনাফুনি করলেন। ‘মেডিকেয়ার’ তাঁকে জানিয়ে দিল, তাদের কিছু করার নেই। ‘এসএসএ’ (সোশ্যাল সিকিয়োরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন— নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির তত্ত্বাবধান করার জন্য স্বশাসিত সংস্থা) যত ক্ষণ না তাঁকে ‘পুনরুজ্জীবিত’ করছে, তত ক্ষণ তিনি ‘প্রয়াত’। তাঁকে ওষুধ দেওয়া যাবে না। নিজের পয়সা খরচ করে ওষুধ কিনতে হবে। অত টাকা কোথায়? ক’টা ভিটামিনের বড়ি কিনে বেরিয়ে এলেন শেরি।
বৃদ্ধার তখন বিহ্বল অবস্থা। এক দিকে চরম হতাশায় ছেয়ে গিয়েছে মন। ভাবছেন কার্ড বাতিল হলে “গ্যাস পাব না, খাবার কেনার টাকা পাব না, কিছুই করতে পারব না।” অন্য দিকে বেশ রোমাঞ্চও হচ্ছে। শেরির ভাষায়, “পৃথিবীর খাতায় আপনি মৃত কিন্তু আপনি তা নন। এ এক অপূর্ব অনুভূতি।” এ ক্ষেত্রে এসএসএ হল এ-যুগের টলস্টয়; তাকে ‘পুনরুজ্জীবিত’ করার ক্ষমতা রাখে। এক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে তিনি নিকটবর্তী এসএসএ অফিসে গেলেন। গিয়ে বললেন, “আমি কত দিন আগে মারা গিয়েছি, আমি তো নিজেই জানি না।” এসএসএ’র লোকজন অমানবিক নন। তাঁরা শেরিকে একটি চিঠি লিখে দিয়ে বললেন, এই চিঠি সাময়িক ভাবে তাঁকে ‘জীবিত’ করল। বাকিটা তাঁরা দেখছেন। ‘মেডিকেয়ার’ জানাল, শেরিকে পুরোপুরি ‘জীবিত’ করতে পঁয়তাল্লিশ দিন মতো সময় লাগবে। ওষুধের দোকান বলে দিল, চিঠিতে ‘জীবিত’ ব্যক্তিকে সেখানে ওষুধ দেওয়া হয় না। কারণ শেরি আর তাঁদের ‘সিস্টেম’-এ নেই। ওষুধ পেতে গেলে কার্ডে ‘জীবিত’ চাই। অতএব শেরি ব্যর্থকাম হয়ে ঘরে ফিরলেন। পঁয়তাল্লিশ দিনের আগে তাঁর ‘জীবিত’ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তত দিন তিনি ‘মৃত’।
শেরির জীবনসঙ্গীও দস্তুরমতো হতাশ। ‘পে চেক’এর উপর নির্ভর করে গত দশ বছর ধরে বেঁচে আছেন তাঁরা। এর জন্য উপার্জন করতে হয়েছে তাঁদের। স্ত্রী শেরি ‘পুনরুজ্জীবিত’ না হলে তো দিন চলা ভার। স্ত্রীর পাশে বসে এই ভাবনায় অস্থির হয়ে যান বৃদ্ধ। শেরি একে তাকে ফোন করেন। ‘মেডিকেয়ার’কে বলেন, তিনি আইনগত ভাবে বেঁচে আছেন কি না, কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অথচ ভুলটা তাঁর নয়। শেরির বক্তব্য, ভুল হয়েছে এসএসএ’র। ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ পাওয়া অন্য কারও ডেথ সার্টিফিকেটের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত করে ফেলেছেন তারা। শেরির প্রশ্ন, “আধ ঘণ্টার মধ্যেই এই ভুল শোধরানো সম্ভব। সেটা কেন হচ্ছে না?” ভুল যদি নিমেষেই হতে পারে, সংশোধন এত সময়সাপেক্ষ কেন?
শেরি এলিসের ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে নিখাদ হাস্যরসের উদ্রেক করে। কিন্তু সেই হাসির পরত সরে গেলে দুই সত্তরোত্তর প্রবীণের অসহায় মুখ ভেসে ওঠে। প্রযুক্তি মানুষের বন্ধু বটে কিন্তু শত্রুতার নিরিখেও তার মোকাবিলা করা খুব কঠিন। কিছু কাল ধরে আমাদের দেশেও ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র হিড়িক উঠেছে। নানান ধরনের কার্ড ইতিমধ্যেই ভরিয়ে ফেলেছে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ভারতীয়ের ওয়ালেট। এক ‘আধার’-এ নাকি সকলকে ঢুকতে হবে। কিন্তু প্রযুক্তি যদি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দেয়, সে সঙ্কট কাটানো সহজ নয়। শেরি শিক্ষিত মহিলা। তাঁর দেশের কর্মসংস্কৃতিকে নির্মম নিন্দার মুখে সচরাচর পড়তে হয় না। তবু পঁয়তাল্লিশ দিনের অসহনীয় অপেক্ষা তাঁর ভাগ্যেও জুটেছে। এই দেড়মাস শেরির অবস্থা ‘জীবিত ও মৃত’। ২০১৬ সালের একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, শুধু এক মাসেই এসএসএ’র কাছে জমা পড়া এক হাজার ডেথ সার্টিফিকেট ভুল জায়গায় পৌঁছেছে। শেরি ‘পুনরুজ্জীবিত’ হতে পারেননি বটে, কিন্তু দুর্ব্যবহার বা উদাসীনতার শিকারও হননি। আমাদের অভিজ্ঞতা অন্য রকম।
কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছিল, সে মরেনি। শেরি এলিসের এমন দুর্ভাগ্য হয়নি। কিন্তু এক জলজ্যান্ত ‘থাকা’কে ‘না-থাকা’ করে দেওয়া আধুনিকতার বোঝা বড় কম ভারী নয়। কাজেই আমাদের দেখতে হবে, আমাদের কাঁধ ততখানি শক্ত কি না। শেরি বার বার সকলকে বলছিলেন, “আমি কষ্টে আছি কিন্তু মরে যাইনি।” জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে পড়ে সে আর্তনাদ বড় হৃদয় বিদারক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy