উত্তরপ্রদেশের মেয়ে, মাতৃভাষা হিন্দি। তিনি হিন্দিতেই লিখছেন, কিন্তু ভাষার সংখ্যাগুরুবাদের ধ্বজা তুলছেন না।
দেশভাগের কথা লিখছেন। ফেলে আসা ভিটেমাটির যন্ত্রণা লিখছেন। কিন্তু আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ লিখছেন না।
গীতাঞ্জলি শ্রী এমন এক জন লেখক, যিনি হিন্দি ভাষায় লিখে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতলেন, কিন্তু ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের’ স্লোগানধারীরা তাতে এতটুকু খুশি হতে পারলেন না। গীতাঞ্জলি তাঁর লেখার মধ্য দিয়েই সে পথ একেবারে বন্ধ করে রেখেছেন।
অথচ ভারতীয় সাহিত্য গীতাঞ্জলি শ্রী-র হাত ধরেই প্রথম আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পেল। সারা পৃথিবী জুড়ে যে কোনও ভাষায় লেখা কাহিনিই এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারে, যদি তা ইংরেজিতে অনুবাদ হয় এবং ব্রিটেন-আয়ার্ল্যান্ডে প্রকাশিত হয়। গীতাঞ্জলির হিন্দি উপন্যাস রেত সমাধি ডেইজ়ি রকওয়েলের ইংরেজি অনুবাদে হয়েছে টুম্ব অব স্যান্ড। দিল্লির গীতাঞ্জলিআর ভারমন্টের ডেইজ়ি, দু’জনেই পুরস্কৃত হচ্ছেন।
২০১৮ সালে প্রকাশিত রেত সমাধি এক আশি বছরের বৃদ্ধার গল্প বলে। স্বামীর মৃত্যুর পর যিনি ক্রমশ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই অবসাদের মোকাবিলা করতেই তিনি পাকিস্তানে নিজের ফেলে আসা ভিটেবাড়ির খোঁজে চলে যান। দেশভাগের অভিজ্ঞতা কিশোরী মনে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, তাতে প্রলেপ ঠিক পড়েনি কোনও দিনই, শুধু চাপা পড়ে গিয়েছিল মাত্র। বইয়ের ব্লার্ব বলছে, বৃদ্ধা এত কাল পরে সেই ঢেকে রাখা ক্ষতের চোখে চোখ রাখতে চাইলেন, মা-মেয়ে-নারী-নারীবাদী এই সত্তাগুলোর অর্থ আবার নতুন করে যাচাই করতে চাইলেন।
বুকারের জুরিরা বলছেন, “এ বই বর্ডারের ধ্বংসাত্মক অভিঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।” বর্ডার, সীমান্ত, প্রাচীর...। ‘শুধু দেশের সঙ্গে দেশের নয়, ধর্মের বেড়া, লিঙ্গের বেড়া’— যেখানেই বেড়া, সেখানেই কাঁটাতার। গীতাঞ্জলির লেখা কাঁটার আঘাতে জর্জরিত। কখনও তাঁর লেখায় বাবরি ধ্বংসের অভিঘাত (হামারা শহর উস বরস), কখনও দুই সমকামী নারীর আখ্যান (তিরোহিত)।
১৯৫৭ সালে উত্তরপ্রদেশের মৈনপুরে জন্ম গীতাঞ্জলির। বাবা ছিলেন তৎকালীন ইলাহাবাদের জেলাশাসক। তাঁর কাজের সূত্রে নানা শহরে ঘুরে গীতাঞ্জলির ছোটবেলাটা কেটেছে। যখন যে শহরে থেকেছেন, স্থানীয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের জনজীবন আর জলহাওয়ায় মিশে বড় হওয়ার ফলে হিন্দি ভাষাটার প্রতি এক গভীর সংযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গীতাঞ্জলি বলছেন, “হিন্দি ভাষা আর সাহিত্যের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল আটপৌরে ভাবে, ব্যক্তিগত স্তরে। বাড়িতে মা হিন্দি ছাড়া কিছুই বলতেন না।” আর মায়ের প্রতি গীতাঞ্জলির টান ছিল নিবিড়। মায়ের নাম শ্রী। সেটা গীতাঞ্জলি নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন। মায়ের সূত্র ধরেই মাতৃভাষার প্রতি দরদ তাঁর বেড়েছে উত্তরোত্তর। বাবা চেয়েছিলেন, লেখালিখি করতে হলে ইংরেজিই ভাল। গীতাঞ্জলি কিন্তু বেছে নিলেন হিন্দিই। উত্তরপ্রদেশের ছোট শহরগুলোয় চার পাশটাই ছিল হিন্দিবেষ্টিত। “আজকের স্কুলপড়ুয়াদের চেয়ে আমরা ছোটবেলায় হিন্দি পত্রপত্রিকা পড়েছি অনেক বেশি। সেটাই বর হয়েছিল।”
রামায়ণ, মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগরের আখ্যান আর চন্দ্রকান্তার অ্যাডভেঞ্চার পড়েই তৈরি হয়েছিল গীতাঞ্জলির জগৎ। তিনি যখন দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে ভর্তি হচ্ছেন, তত দিনে হিন্দি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়াটি বাঁধা হয়ে গিয়েছে। প্রেমচন্দের পৌত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে হিন্দিতে যে হেতু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই, তাই হিন্দি নিয়ে পড়া গেল না। গীতাঞ্জলি বেছে নিলেন আধুনিক ভারতের ইতিহাস। টিউটোরিয়ালে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে দেদার ব্যবহার করতে লাগলেন হিন্দি সাহিত্যের আহরণ। স্নাতকোত্তর পাঠ নিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পর বরোদার মহারাজা সওয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমচন্দকে নিয়ে তাঁর গবেষণা।
গবেষণার কাজ চলতে চলতেই হিন্দি সাহিত্যের জগতে গীতাঞ্জলির সরাসরি পদার্পণ ঘটল ১৯৯১ সালে। বেরোলো তাঁর প্রথম ছোটগল্পের বই অনুগুঞ্জ। প্রথম গল্প ‘বেল পত্র’ লিখেছিলেন তারও চার বছর আগে। কিছু দিন শিক্ষকতাও করেছিলেন, তার পর পুরোপুরি লেখায় মন। প্রথম উপন্যাস ছিল মাই (২০০১)। তার পর হামারা শহর উস বরস, খালি জগাহ, গল্পগ্রন্থ ইঁহা হাতি রহতে থে। ২০১৮ সালে রেত সমাধি— ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বুকার।
গীতাঞ্জলি খুশি অবশ্যই। বর্তমান পারিপার্শ্বিকতায় যতটা খুশি হওয়া যায়! গীতাঞ্জলির কথায় বললে, “লেখার কাজটা তৃপ্তিরই। তার সঙ্গে বুকারের মতো স্বীকৃতি এলে সেটা দারুণ বোনাস! আসলে চার দিকে সব কিছুই এত নৈরাশ্যজনক, শিল্প-সাহিত্যে একটা সদর্থক বাতাবরণ তৈরি হলে তার একটা মূল্য আছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy