Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

লালকমলের আগে

তাই অন্ধকারে ক্রমাগত হাতড়ে বেড়ানো। একজোড়া নাম। রহিম-রাম। ফরিদ-গোপাল। কওসর-অসীম। ৭১ বছর পিছিয়ে গেলে সেই তালিকাতেই পাওয়া যাবে ইয়াসিন ফকির-গিরিধর মণ্ডলকে।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৭ ১৩:৩৫
Share: Save:

নোয়াখালি হাঙ্গামার শোচনীয় ঘটনার মধ্যে থেকে একটা আশার আলোও ভেসে আসে। বিভেদ-বিচ্ছেদ ও তিক্ততার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে মিলনের আহ্বান। রামনগর থানার হাঙ্গামা-এলাকার পাশে ত্রিপুরা জেলার সীমানা পার হয়েই হাসনাবাদ গ্রাম ও এলাকা পড়ে। কৃষকসভার নেতৃত্বে এই এলাকার অন্তত এগারোখানা গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান কৃষকরা মিলিতভাবে উদ্ধার করেন ও নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেন প্রায় তিন হাজার দুর্গত ও পলাতক নারী-পুরুষ হিন্দুকে। এই এলাকায় তখন মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা অন্তত শতকরা ৮০ জন।’’ (কৃষকসভার ইতিহাস, মুহম্মদ আবদুল্লা রসুল)। ১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তার পর কেটে গিয়েছে ৭১টা বছর। সময় এগিয়েছে, যুগ এগিয়েছে, আধুনিকতা এগিয়েছে। শুধু মুছে যায়নি পরিচয়কেন্দ্রিক জীবনযাপন। আর কিছু প্রবৃত্তি।

তাই অন্ধকারে ক্রমাগত হাতড়ে বেড়ানো। একজোড়া নাম। রহিম-রাম। ফরিদ-গোপাল। কওসর-অসীম। ৭১ বছর পিছিয়ে গেলে সেই তালিকাতেই পাওয়া যাবে ইয়াসিন ফকির-গিরিধর মণ্ডলকে। ‘‘এর পর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ৬০ লক্ষ চাষি এই সংগ্রামে অংশীদার হন। শত শত কৃষক লাঠি ও গুলির আঘাতে নিহত হন। এর পর শুরু হয় বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গার বিরুদ্ধে কৃষকরাও রুখে দাঁড়ালেন। আমাদের গ্রামের ৬০ বছরের বৃদ্ধ এয়াছিন ফকির, অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা গিরিধর মণ্ডল স্বেচ্ছাসেবক হয়ে যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ থাকে তার জন্য সর্বত্র প্রচার শুরু করেন। কৃষকসভার কর্মীরাও সর্বত্র গ্রাম্য বৈঠক করে কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমন করেন, সে-কারণে আমাদের অঞ্চলে কোনো দাঙ্গা হয়নি।’’ তেভাগার স্মৃতিচারণা করেছেন সুবল মিত্র।

মৌভোগ। বাংলাদেশের খুলনা জেলায় ছোট্ট এক গ্রাম। দেশভাগের সময় গ্রামটি কোন এলাকায় পড়বে, ‘হিন্দুস্তান’ না ‘পাকিস্তান’, তা নিয়ে তর্ক ওঠে। মতান্তর থেকে মনান্তর। মনান্তর থেকে হিংসা। হিংসা রুখে দেন দুই গ্রামবাসী, ইয়াসিন এবং গিরিধর। মৌভোগ বিষ্ণু দে-র এক কবিতার শিরোনামও বটে।

এই দুই বীরের কথাই নিশ্চয় কবিতাটায় বলেছেন বিষ্ণু দে। তবে কাহিনিটি তুলে এনেছেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার সম্পাদিত ‘দেশজননীর বুকের কথা’ ঠাকুরমার ঝুলি থেকে। কেন? এ দেশের ঘরে ঘরে, পুকুরপাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এমন সম্প্রীতি, সেটাই মনে করিয়ে দেওয়া। বিষ্ণু দে করেছিলেন ১৯৪৬-এ। ২০১৭’য় তা ফের স্মর্তব্য।

‘‘নীলকমলের আগে লালকমল জাগে/ আর জাগে তরোয়াল/ দপ্ দপ্ করে ঘিয়ের দীপ জাগে—/ কা’র এসেছে কাল?’’— হিংসার এসেছে কাল, দাঙ্গার এসেছে কাল। কাল অর্থাৎ নাশ। আর সে কাজ হচ্ছে লালকমল-নীলকমল জেগে উঠছে বলেই। সে-যুগের লালকমল-নীলকমল হলেন ইয়াসিন-গিরিধর। কৃষকসভার নেতৃত্বে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের তাঁরা অংশীদার ছিলেন, তার নাম তেভাগা আন্দোলন। মানুষের ধর্মীয় পরিচয়টা যখন সবার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখনই শুরু হয় দাঙ্গা। তেভাগা আর ইয়াসিন-গিরিধর চেয়েছিলেন সেই মোহময় পরিচয়ের জালটা ছিঁড়ে ফেলতে। তাদের আসল পরিচয়টা বড় করে চিনিয়েছিলেন তাঁরা। কৃষকের পরিচয়। তাদের লড়াই গোলার ধান ছিনিয়ে নেওয়া জমিদারের বিরুদ্ধে। ভাত-কাপড়ের আসল লড়াইয়ে থাকলে আর এই ঠুনকো পরিচয়টা বড় হয়ে দেখা দেয় না।

বার বার তাই লালকমল-নীলকমলের কথা। পরে আর একটা কবিতা লেখেন বিষ্ণু দে: হাসনাবাদেই। শিরোনামেই মালুম হয় আজও একই রয়ে গিয়েছে বধ্যভূমি। একেবারে প্রথমে যে-প্রসঙ্গ উদ্ধৃত করা হল, তা এ কবিতা সম্পর্কেই। এ বার সরাসরি রাম-রহিম প্রসঙ্গই এসেছে কবিতায়। বাংলার নানা পরিচিত অনুষঙ্গ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ধুয়োর মতো ফিরে এসেছে নামবন্ধ। প্রতিটি চরণের শেষেই। বাংলার মানুষ দাঙ্গা চান না, উচ্চকণ্ঠে বলেছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা। কারণ তাঁরা দেখেছেন ওতে কোনও লাভ হয় না, শুধুই ক্ষতি। কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে। বাংলা ঠেকে শিখেছিল ১৯৪৬-এ। ফের শিখছে ২০১৭-য়। তারা নিজেরা লড়ে না। কেউ রাজনৈতিক স্বার্থেই তাদের লড়িয়ে দেয়। শেষমেশ ভস্মীভূত বাড়িঘর-দোকানপাটের স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে চোখের জল ফেলে রহিম-রাম। ভুল বোঝাবুঝি ভুলে রাখি বেঁধে দেয় একে অপরের হাতে। ‘‘রাক্ষসী রানি বুঝি ভয়ে হল হিম—/ মরণকাঠি যে তার হাসনাবাদেই/ এক হাতে ভাঙে শত রাম ও রহিম।’’

কবিতা দুটো যে বইয়ের, তার নাম সন্দ্বীপের চর। আজ সন্দ্বীপ নামটা বিস্মৃত। ১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ দৈনন্দিনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সন্দ্বীপের নাম। মেঘনার মোহনায় এক দ্বীপ। দেশভাগ পূর্ববর্তী দাঙ্গায় শামিল হয়েছিল সে-ও। সেখানেই দাঙ্গা থামাতে গিয়েছিলেন এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, লালমোহন সেন (ছবিতে)। তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আন্দামানে বন্দি ছিলেন দীর্ঘ দিন। সন্দ্বীপের চরে হিংসা থামাতে গিয়ে নিহত হন লালমোহন। দাঙ্গাবিরোধিতার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। আর জেগে থাকেন বিবেকবান বাঙালির মনে।

আমরা ঠেকে শিখেছি। আমরা জানি পদ্ধতি। তাই আমরা আজও খুঁজে চলেছি শত শত ইয়াসিন-গিরিধরকে। শত শত লালমোহনকে। যাঁরা মুখোমুখি সংঘাতটা রুখে দেবেন। আর চিনিয়ে দেবেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE