প্রতীকী ছবি।
রাজনীতিটি বিলক্ষণ গোলমেলে। এক দেশ, অতএব তাহার করব্যবস্থা হইতে খাদ্যাভ্যাস, সমস্তই অভিন্ন হইতে হইবে, এই কথাটি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে যেমন ক্ষতিকারক, সামাজিক বিভিন্নতার পক্ষেও তেমনই। ‘এক দেশ, এক ব্যবস্থা’ কথাটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কানে অগ্রহণযোগ্য ঠেকিতে বাধ্য। অথচ গোটা দেশের জন্য অভিন্ন রেশন কার্ড চালু করিবার অতি জরুরি নীতিটিকেও ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান রেশন কার্ড’-এর গোলমেলে মোড়কে পেশ করা হইল। খাদ্য সরবরাহের প্রশ্নটি যেহেতু সংবিধানের কনকারেন্ট লিস্ট বা সংযুক্ত তালিকার অন্তর্ভুক্ত, ফলে রেশন বণ্টনের প্রশ্নে রাজ্য সরকারেরও অধিকার আছে। আশা করা চলে, ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’ নীতির অস্ত্রে রাজ্যের অধিকার কাড়িয়া কেন্দ্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হইবে না। ব্যবস্থাটি যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির অধিকার খর্ব করিবার ছল হইয়া দাঁড়ায়, তাহা অতি দুর্ভাগ্যজনক হইবে, কারণ এক দেশের উপর এত দিন যত অভিন্ন ব্যবস্থা চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহার মধ্যে এক রেশন কার্ড নীতিটি সর্বাপেক্ষা উন্নয়নবান্ধব। বস্তুত, স্লোগান ব্যতীত এই নীতির প্রয়োজনীয়তা লইয়া সংশয় নাই।
নীতিটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা একটি সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারের উপর ইহার ভিত্তি। ভারতের যে কোনও নাগরিক দেশের যে কোনও প্রান্তে কাজের সূত্রে বা অন্য কারণে বসবাস করিতে পারেন। অর্থাৎ, ভারতের ভৌগোলিক পরিসরে নাগরিকের গতি অবাধ। কিন্তু, এত দিন অবধি যেহেতু রেশন কার্ড ডিলার-নির্দিষ্ট হইত, ফলে যে স্থলে কার্ড করানো হইয়াছে, তাহা ছাড়িয়া গেলে রেশন পাইবার উপায় থাকিত না, অন্তত যত দিন না নূতন বাসস্থানের বাসিন্দা হিসাবে নাম পাকা হইতেছে। মার্চ মাসের লকডাউন দেখাইয়া দিয়াছে, শুধুমাত্র খাদ্যের অভাব পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে কী ভাবে বিপন্ন করিতে পারে। যে শহরে তাঁহাদের কাজ, সেখানে খাতায়-কলমে তাঁহাদের অস্তিত্বই নাই, ফলে রেশন পাইবারও প্রশ্ন নাই। অর্থাৎ, ডিলার-নির্দিষ্ট রেশন কার্ড নাগরিকের ভিন্ অঞ্চলে বাস করিবার অধিকারের পরিপন্থী। তাহা নাগরিকের খাদ্যের সুরক্ষার অধিকারেরও পরিপন্থী। গোটা দেশের জন্য অভিন্ন রেশন কার্ড চালু করিলে নাগরিকের এই অধিকার অর্থপূর্ণ হইতে পারে।
উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ হইতে এই অভিন্ন রেশন কার্ডের গুরুত্ব অতএব বিরাট। খাদ্য মানুষের অধিকার— কে কোথায় বাস করিতেছেন, সেই প্রশ্নের উপর এই অধিকার নির্ভরশীল হইতে পারে না। খাদ্যের অক্ষুণ্ণ জোগান উন্নয়নের আবশ্যিক শর্তও বটে। খাদ্য ও পুষ্টির ব্যবস্থা হইলে মানুষের উপার্জিত অর্থ ভিন্নতর প্রয়োজনে— সন্তানের শিক্ষায়, চিকিৎসায়, ব্যবসা চালু করিবার কাজে অথবা অন্য কিছুতে— ব্যয় করিবার ক্ষমতা তৈরি হয়। অর্থশাস্ত্রীরা বলিবেন, এই ক্ষমতাটির গুরুত্ব অসীম। উন্নয়নের অধিকারী হইবার জন্য যে ‘স্ব-ক্ষমতা’ প্রয়োজন, কর্মস্থলে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হইলে সেই ‘স্ব-ক্ষমতা’ অর্জনের পথে বেশ খানিক দূর অগ্রসর হওয়া যায়। কেহ বরং এই কথা ভাবিয়া অবাক হইতে পারেন, বাজার ব্যবস্থায় যাঁহার বিশ্বাসের উপর জগদীশ ভগবতীরাও ভরসা করিতেন, সেই নরেন্দ্র মোদী রেশন ব্যবস্থার ন্যায় বাজার-বহির্ভূত বণ্টনকে এমন গুরুত্ব দিতেছেন। বিহারের বিধানসভা নির্বাচন একটি কারণ, সন্দেহ নাই। রাজনীতিকের নিকট সবার উপরে রাজনীতি সত্য, কিন্তু সেই রাজনীতির লক্ষ্যেও মানুষের উপকার হইলে তাহা প্রফুল্লকর সংবাদ। ভারতে রাষ্ট্র যখন নাগরিকের খাদ্যের অধিকার রক্ষায় আইনত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তখন সেই প্রাপ্তির জন্য নাগরিককে একটি ঠিকানায় আটকাইয়া না রাখিয়া গোটা দেশে তাহার রেশনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করিবার সিদ্ধান্তটি মানবোন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হইয়া থাকিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy