Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
U.S Election 2020

সামনে বড় লড়াই, তবুও আশা

গত ক’বছরে বার্নি স্যান্ডার্স এবং এলিজ়াবেথ ওয়ারেনের মতো সেনেটরদের কাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন প্রজন্মের কিছু জনপ্রতিনিধি গণতন্ত্রে নতুন জোয়ার এনেছেন।

অলোকেশ দত্তরায়
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২০ ০০:৫৩
Share: Save:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস জয়ী হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ বলে আস্ফালন চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোটগণনার পদ্ধতি এবং প্রাপ্ত ভোট নিয়ে বিতণ্ডা চলছে। তবে সেই হিসাবনিকাশের বাইরে এসে নির্বাচনের আসল প্রভাবে মনোনিবেশ করলে দেখব যে, এই মুহূর্তে আমেরিকার পরিস্থিতি সত্যিই উদ্বেগজনক। গত চার বছরে ট্রাম্প ও তাঁর দলের কট্টরপন্থীদের দাপটে পৃথিবীর বহু মানুষের স্বপ্নের দেশ এখন দুঃস্বপ্নের ঘোর বাস্তব।

কোভিড-আক্রান্ত আমেরিকার সরকারের নাজেহাল দশা দেখে অনেকেই অবাক। ‘উন্নত’ পশ্চিমি দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান উন্নত হবে, এটাই স্বাভাবিক। স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা পশ্চিম ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ, পূর্বে নিউ জ়িল্যান্ডও অতিমারি রুখে দিতে কমবেশি সফল। তা হলে আমেরিকায় মৃত্যুমিছিল অব্যাহত কেন? এই দেশ তো স্বাস্থ্য আর বিজ্ঞানের সমস্ত সম্পদের ভান্ডার নিয়ে বসে আছে— বিশ্বের সবচেয়ে সফল বায়োফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা, সবচেয়ে নামী বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বাধিক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, সবচেয়ে দক্ষ হাসপাতাল পরিকাঠামো, সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা, দক্ষ মানুষদের সমাবেশ।

আমেরিকার মূল সমস্যা লুকিয়ে আছে ১ শতাংশের সঙ্গে বাকি ৯৯ শতাংশের তুমুল সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক পাওয়া-না-পাওয়ার বিভেদে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকামী রাজনীতি এবং তার চেয়েও ক্ষমতাশালী ওয়াল স্ট্রিটের ‘অলিগার্কি’র অসামান্য ক্ষমতা সে দেশের সঙ্কট বইকি।

অতিমারি ঠেকানো গেলেও আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটকে জয় করা সহজ হবে না। আমেরিকার পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটিক দলের মধ্যে ভোটে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছাড়া খুব একটা ফারাক নেই। ওয়াল স্ট্রিট পরিচালিত স্টক মার্কেটের অর্থনীতির ওঠানামার কলকাঠিই রাজনীতির প্রধান পরিচালক। সেই ১ শতাংশের ধ্বজাধারী লবিস্টদের হাতে থাকে ৯৯ শতাংশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। পুঁজিবাদ মানেই খারাপ নয়, মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, এগিয়ে চলার পাথেয়, বিজ্ঞানের অগ্রগতি এই ব্যবস্থার দান। কিন্তু অপপ্রয়োগের ফলে এই ব্যবস্থা মানুষে মানুষে সাঙ্ঘাতিক বৈষম্যের চূড়ান্ত প্রতিফলন হয়ে দেখা দিয়েছে, অতিমারি যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি আর নিয়ো-লিবারাল সমাজের সবচেয়ে বেশি ফয়দা তোলে চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং একনায়কতন্ত্রী নেতারা। আমেরিকায় ট্রাম্প, ভারতে নরেন্দ্র মোদী, ব্রাজিলে বোলসোনারো, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন— তালিকা বেড়েই চলেছে। এর ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলির সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। লিঙ্গবৈষম্য এবং ধর্ম ও বর্ণভেদ যেটুকু ঘোচানোর চেষ্টা হয়েছিল, তা বিনষ্ট হচ্ছে।

ধনবৈষম্যের ফলে পিছিয়ে পড়া কালো চামড়ার বা লাতিন আমেরিকার দেশ থেকে আসা মানুষদের রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে দমিয়ে রাখা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আর অর্থনীতির সঙ্কটে কেবল কালো বা বাদামি মানুষেরা পিছিয়ে পড়ছেন এমন নয়, আধুনিক আমেরিকার ভিত্তিস্বরূপ বহু সাদা চামড়ার ‘ব্লু-কলার’ অতিমারির পরে আজ কর্মহীন। এই কর্মহীনতার কারণ বিশ্বজনীন নিয়ো-লিবারাল ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণি, ট্রাম্প তাদেরই প্রতিভূ। অথচ, তিনি এই লোকগুলোকেই সবচেয়ে বেশি খেপিয়ে তুলেছেন। মূল সমস্যা থেকে নজর ঘুরেও গিয়েছে। বেড়েছে হতাশা, ডিপ্রেশন, আত্মহত্যা। বেশির ভাগই ‘ব্লু-কলার’দের ক্ষেত্রে। এই সব সমস্যা নিয়ে যাঁরা কথা বলতে গিয়েছেন, সৎ ভাবে আন্দোলনের পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের ‘সোশ্যালিস্ট’ বা ‘কমিউনিস্ট’ তকমা দিয়ে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ, বার্নি স্যান্ডার্স। দক্ষিণ এবং মধ্যপন্থী, দুই গোষ্ঠীই এ ক্ষেত্রে সমান। এত ধ্বংস-মৃত্যুর পরেও, ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন বিরাট সংখ্যক মানুষ, যাঁরা বিভেদ ও দমননীতির প্রচারে ভীত এবং বশীভূত।

তবুও, ট্রাম্পের মতো লাগামছাড়া ভয়ানক একনায়ককে হারানোটা ছিল এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কাজ। গত ক’বছরে বার্নি স্যান্ডার্স এবং এলিজ়াবেথ ওয়ারেনের মতো সেনেটরদের কাজের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন প্রজন্মের কিছু জনপ্রতিনিধি গণতন্ত্রে নতুন জোয়ার এনেছেন। যেমন, আলেকজ়ান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কর্তেজ়। এঁরা রাজনীতির বাঁধাধরা নিয়ম তুচ্ছ করে সোজাসাপ্টা ভাষায় নতুন পথের দিশা দেখাচ্ছেন। এই নির্বাচনে তাঁদের প্রতি আস্থা রেখেছেন মানুষ। আশা জাগে, রাজনীতি থেকে মূল্যবোধ ব্যাপারটা হয়তো একেবারে হারিয়ে যায়নি। লোক-খেপানো কথার কারসাজিতে কান না দিয়ে এই নির্বাচনেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন।

মানুষে মানুষে বিভেদ হয়তো কোনও দিনই পুরোপুরি যাবে না, তবু তাকে প্রশমিত করার প্রথম পদক্ষেপ রাজনীতির হাত ধরে আসা দরকার। এই ফলাফলের সবচেয়ে বড় সাফল্য সেখানেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy