গত চার বছরে আমেরিকা দেশটি চলল টেলিভিশনের কোনও রিয়্যালিটি শো-এর মতো। যে রিয়্যালিটি শো-এর দৌলতে আমেরিকার ঘরে ঘরে ট্রাম্প পরিচিতি পেয়েছিলেন, তার মেজাজেই দেশ শাসন করলেন তিনি। বাস্তব, বিজ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের প্রতি চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য দেখিয়েছেন ট্রাম্প। অনুভূতিহীনতায়, আত্মশ্লাঘায় দেশ এবং দশ ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে ‘আমি’। আত্মপ্রচার ও গা-জোয়ারিই সেখানে শেষ কথা। অথচ নরেন্দ্র মোদী, বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু বা জাইর বোলসোনারোর মতন অন্য দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়কদেরও যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে, তার ছিটেফোঁটা ট্রাম্পের নেই। ফলে বেমক্কা গা-জোয়ারিতে হিতে বিপরীত হয়েছে। আমেরিকার এবং খোদ ট্রাম্পের। মে মাস থেকে অক্টোবর অবধি কোভিডে প্রাণ হারালেন সওয়া এক লাখের বেশি আমেরিকান। শেষ ছ’মাস ধরে কোভিড টেস্টিং এবং চিকিৎসা-সামগ্রীর অপ্রতুলতায় জেরবার হয়েছেন যুগপৎ রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মী, এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের অসারতা প্রমাণ করে স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। বর্ণবৈষম্য নিয়ে দেশ জুড়ে আগুন জ্বলেছে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিল বার করেছে নব্য-নাৎসির দল, চিনের সঙ্গে অনভিপ্রেত বাণিজ্যযুদ্ধে বিপুল ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের, রাশিয়া-চিনের কূটনৈতিক দাপটে কোণঠাসা আমেরিকা পাশে পায়নি ইউরোপের বৃহৎ শক্তিদের।
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে এসে একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেল, ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন অন্ততপক্ষে বাহান্ন শতাংশ আমেরিকানের পছন্দসই প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠেছেন। ট্রাম্প সেখানে পাশে পাচ্ছেন মাত্রই বিয়াল্লিশ শতাংশ দেশবাসীকে। প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা অনেক সময়েই সঠিক জনমত বুঝে উঠতে পারে না, তবে, চার বছরের গড় জনপ্রিয়তার হিসেবেও ট্রাম্পের ভাঁড়ারে জমা পড়েছে মাত্রই ৪০ শতাংশ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকায় সর্বনিম্ন।
তবে ট্রাম্পের চার বছরের শাসনেই আমেরিকায় জাতি-বর্ণ-ধর্ম ও রাজনীতিভিত্তিক বিভাজন এমনই বেড়েছে, বাইডেনের কাজ খুব সহজ হবে না। কট্টর রিপাবলিকানদের প্রায় ৯৪ শতাংশ ট্রাম্পের পাশে রয়েছেন। ১৯৯৩-এ বিল ক্লিন্টন যখন জর্জ বুশের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তখন কিন্তু রিপাবলিকান ভোটারদের কুড়ি শতাংশ ছিলেন ক্লিন্টনের সঙ্গে।
বাইডেন তবে ঠিক কোন অবস্থানটি নিলে সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় থাকবেন? গর্ভপাতের প্রশ্নটিকে ধরেই দেখা যাক। ডেমোক্র্যাট ভোটারদের প্রায় বিরাশি শতাংশ গর্ভপাতকে সমর্থন করেন। শেষ এক দশকে বার্নি স্যান্ডার্স বা আলেকজ়ান্দ্রিয়া কর্তেজ়-এর মতো একাধিক উদারবাদী ডেমোক্র্যাট নেতার তৃণমূল স্তরভিত্তিক আন্দোলনের ফলে অন্তত কুড়ি শতাংশ বেশি ভোটার গর্ভপাতের পক্ষে মত দিতে শুরু করেছেন। জো বাইডেনের কাছে এই ভোটারদের আশা, তিনি খোলাখুলি গর্ভপাতের সমর্থনে মুখ খুলবেন। অতএব রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে পাওয়ার আশায় বাইডেন যদি গর্ভপাত প্রসঙ্গে চুপ থাকেন, তা হলে উদারপন্থী এই ডেমোক্র্যাট ভোটারদের অনেকে হয়তো ভোট দিতেই যাবেন না। ২০১৬-র নির্বাচনে হিলারি ক্লিন্টনের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল যথেষ্ট সংখ্যক ডেমোক্র্যাটদের ভোট না পড়া। কাজেই বাইডেন কোনও ঝুঁকি না নিয়ে চাইবেন সমস্ত ডেমোক্র্যাটিক ভোটারকে পাশে পেতে। তাই বাইডেনের নির্বাচনী ইস্তাহার নিয়মমাফিক উদারপন্থী।
রিপাবলিকানদের কাছে পেতে বাইডেনের মন্ত্র অন্য, তিনি এক দ্বিখণ্ডিত দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা জানাচ্ছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছেন কোভিডোত্তর পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্যও দরকার ঐক্য— হাউস ও সেনেটের বিভেদে গত চার বছরে বারে বারে থেমে গিয়েছে আমেরিকান অর্থনীতির চাকা।
তবে শুধু প্রথাগত রাজনৈতিক আদর্শের লড়াই লড়ে যে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যাবে না, সে কথা বিলক্ষণ জানেন দুই প্রার্থীই। ট্রাম্প তাই প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্প্যানিক বা হিন্দু ভারতীয় ভোটারদের পাশে পেতে। শ্রেণি-উত্তরণের স্বপ্ন এবং ধর্ম তাঁর তুরুপের তাস। চিরাচরিত স্টাইলে জানাচ্ছেন, বাইডেন ক্ষমতায় এলে আমেরিকা হবে এক সমাজতান্ত্রিক দেশ। সেখানে না থাকবে অর্থোপার্জনের স্বাধীনতা, না থাকবে ধর্মাচারের সুযোগ।
আমেরিকান আমজনতার কাছে কমিউনিজ়ম এবং সোশ্যালিজ়ম যে সমার্থক, সে কথা জানেন জো বাইডেনও। তিনি দেখেছেন বছরখানেক আগে বামপন্থী নেতা জেরেমি করবিন কী ভাবে ব্রিটিশ নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছেন। দেখেছেন বামপন্থী বার্নি স্যান্ডার্সের রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার সম্ভাবনায় কী ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন তাঁর দলের লোকরাই। ফলে বাইডেন রাখঢাক না করেই কর্পোরেট আমেরিকার থেকে সাহায্য নিচ্ছেন। ওয়াল স্ট্রিট এবং সিলিকন ভ্যালিতে বাইডেনের পকেটে বহু মিলিয়ন ডলার গুঁজে দেওয়ার লোকের অভাব নেই এই মুহূর্তে। আবার, একই সঙ্গে বাইডেনকে প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির বা লিঙ্গভিত্তিক পারিশ্রমিক-বৈষম্যের অবসান ঘটানোর। মহিলা এবং তরুণ ভোটারদের নিয়ে বাইডেন ক্যাম্পের আশা প্রবল, অতএব এই আপাত-অসম্ভব ভারসাম্যের খেলা থেকে সহজে নিস্তার নেই তাঁর।
গ্রেটা থুনবার্গের প্রজন্মকে কাছে পাওয়ার আশায় বাইডেন আবার দুই বিলিয়ন ডলারের এক ‘গ্রিন নিউ ডিল’ ঘোষণা করেছেন। সে টাকা কর্পোরেট আমেরিকাকে রুষ্ট না করে, অর্থাৎ কর সাঙ্ঘাতিক না বাড়িয়ে কী ভাবে তোলা যাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু সে প্রশ্ন তুলতে এখনই উৎসাহী নন শিক্ষিত, উদারপন্থী আমজনতা। ট্রাম্পকে হারাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর, তাই বাইডেনের বহু প্রতিশ্রুতি বাস্তবিক নয় জেনেও তাঁরা বিশ্লেষণে যেতে চান না।
ট্রাম্পের আমেরিকার ট্র্যাজেডি এটাই, বিভাজনের ফাঁদে না পড়ে উপায় নেই। ৩ নভেম্বর যদি অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের অনুমান ভুল প্রমাণ করে ট্রাম্প ফের মসনদ দখল করেন, তা হলে এই অতিবিভাজনের ফাঁদ থেকে নিস্তারের আর কোনও রাস্তাই খোলা থাকবে না। পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্রটি আদৌ টিকবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy