শান্তিনিকেতনে শ্যামবাটিতে ময়ূরাক্ষী সেচ ক্যানালে কলেজ পড়ুয়াদের সেলফি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
এক বহুজাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থার ট্যাগলাইন ছিল—‘করলো দুনিয়া মুঠ্ঠি মে’। তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, দুনিয়াটাকে আবার মুঠির মধ্যে ভরা যায় নাকি? এ-ও কি সম্ভব?
তবে, আজকের জীবন যাত্রার প্রতিটা ক্ষণে বুঝতে পারছি, বিজ্ঞাপনের কথাগুলি বাস্তবতাকে কতখানি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে! আজ সত্যিই তো আমাদের জীবন মুঠোফোনেই বন্দি! হাতে একটা স্মার্টফোন থাকলে জগতের সব কিছুই আজ আমাদের নাগালের মধ্যে। আজ এত বড় পৃথিবীটা যেন এত বড়ই নয়, ছোট্ট চারকোনা মোবাইলে সে বন্দি। মোবাইল স্ক্রিনে গিয়ে গুগলে সন্ধান করলে পাওয়া যায় বীরভূম থেকে ব্রাজিল, হুগলি থেকে হনুলুলু, নদিয়া থেকে নর্থপোলের হিরে থেকে জিরে।
এটা ঘটনা যে, মুঠোফোন আজ আমাদের কাছে জীবনকে করে তুলেছে আরামের, সহজ। ট্রেনের রিজার্ভেশনের জন্য আজ আর ভিড় লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না, ব্যাঙ্কে গিয়ে লম্বা লাইনে টাকা লেনদেন করতে হয় না, ইলেকট্রিক বিলের হ্যাপাও ঘরে বসেই মিটে যায়, এসটিডি বুথে গিয়ে রিচার্জ করানোর দিনও কার্যত শেষ। বোলপুরে বসে বার্লিনে প্রিয়জনের সঙ্গে শুধু কথাই নয়, প্রিয়জনের চোখে চোখ রেখে কথাও বলা যায় হাতে মুঠোফোন টুকু থাকলেই। মোদ্দা কথায়, মোবাইল থাকার অর্থ ঘরে বসেই বাইরের অর্ধেক কাজ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, হাতে অনেক বেশি সময় পাওয়া। সেই সময় কি আমরা বন্ধুর সঙ্গে বা আত্মীয়ের সঙ্গে বসে গল্প করে কাটাই, নাকি তার খোঁজখবর নিয়ে হৃদ্যতাকে বাড়িয়ে তুলি? তলিয়ে দেখলেই জানা যাবে, যে মানুষটির মোবাইল নেই, তিনিই বরং মানুষকে বেশি সময় দেন, তার সঙ্গে দেখা হলে সৌহার্দ্য বিনিময়ের সময়টুকু তাঁর হাতেই অনেক বেশি থাকে। কয়েক জন বন্ধু বা পরিচিত মানুষ যদি ট্রেনে,বাসে, খেলার মাঠে কখনও একত্রিত হন, তা হলে পরিচিত দৃশ্যটি নজর এড়ায় না। ঘাড় নিচু করে প্রত্যেকে নিজের মোবাইলে মগ্ন, পাশের পরিচিত জনের সঙ্গে কথা বলার ফুরসতটুকুও যেন নেই। বাইরের বৃহৎ জগৎ থেকে যেন শামুকের মতো আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি, ঢুকে যাচ্ছি এক অদ্ভুত গহ্বরে।
যত দিন যাচ্ছে, মানুষ তত বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে স্মার্টফোনে। আসক্ত বললেও খুব কম বলা হয়, বলা ভাল দাসানুদাসে পরিণত হচ্ছে। এমনই এর আকর্ষণ ক্ষমতা যে আট থেকে আশি, প্রত্যেকেই কমবেশি এর বশ্যতা স্বীকার করছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া এবং মোবাইল গেমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা কেউ বুঝতেও পারে না বাকি পৃথিবী থেকে, কল্লোলিত জীবনের রূপ-রস-গন্ধ থেকে সে ধীরে ধীরে কী ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই নেশা অতি ভয়ানক, একে একপ্রকার রোগই বলা যায়। জ্বর বা পেটখারাপে যেমন নানা উপসর্গ দেখা দেয়, এই মুঠোফোনের রোগেও তেমনি একাধিক লক্ষণ থাকে। মাথাটি প্রায়ই নীচের দিকে নেমে থাকে। হাতের আঙুল বিশেষত বুড়ো আঙুল আর তর্জনী সব সময় সক্রিয় থাকে। বাইরের কারও ডাক প্রথমে কানে শুনতে পাওয়া যায় না, মাঝেমধ্যে ক্ষণিকের বধিরতা গ্রাস করে। নীচের দিকে মাথা নামানো অবস্থায় আপন মনে হাসি আসে, দাঁত কিড়মিড় করে। আরও একাধিক লক্ষণ থাকতে পারে। এগুলি দেখা গেলে খুব নিশ্চিত ভাবে বোঝা উচিত, যে সে মুঠোরোগে আক্রান্ত।
তেমনই আর এক রোগের নাম ‘সেলফি-রোগ’। স্মার্টফোনের হাত ধরেই আধুনিক বিশ্বে এ রোগের আমদানি। যে কোনও জায়গায়, যে কোনও পরিস্থিতিতে, সে যতই দৃষ্টিকটূ হোক না কেন, মোবাইল মুখের সামনে হাতে ধরে একটা নিজস্বী তুলে নেওয়া। সেলফি বা নিজস্বী যদি কারও শখ হয়, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু, এ নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে ইদানীং প্রশ্ন উঠছে। নিজস্বী তোলা এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় মরিয়া ভাবে পোস্ট করার প্রবণতাকে এক ধরনের মানসিক বৈকল্য বলে চিহ্নিত করেছেন একদল গবেষক। তাঁরা এই ‘রোগের’ নাম দিয়েছেন ‘সেলফাইটিস’। যদিও নিজস্বী তোলার ঝোঁক আদৌ রোগ কিনা, তা নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
তবে, এতে সন্দেহ নেই, দিন দিন এই প্রবণতা মারাত্মক চেহারা নিচ্ছে। যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও জায়গায় নিজের ছবি তুলে ফেসবুকে সেঁটে দাও, একেই বলে ‘স্টেটাস’ দেওয়া। স্রেফ বিয়েবাড়ি বা পুজোয় ঠাকুর দেখা কিংবা বেড়ানোর সময়ে নয়, আকছার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে পোস্ট করাটাও আসক্তির চেহারা নিয়েছে। ছবির সঙ্গে কিছু বাক্যও লেখা থাকতে পারে। তবে তার বানান এবং উচ্চারণ বোঝার ক্ষমতা অনেক সময় নিজ নিজ প্রতিভার উপর নির্ভর করে। যেমন ‘ছি’ শব্দটিকে ইংরেজি অক্ষরে লিখলে ‘সিএইচআই’ না-ও লেখা থাকতে পারে, লেখা থাকবে ইংরেজি ‘6’, তার পরে আই। তাতেই বুঝে নিতে হবে ওটি ‘ছি’। মনে পড়ে ছেলেবেলায় বাবার একটি ক্যামেরা ছিল। ঘাড় থেকে ফিতের সাহায্যে বুকের কাছে ঝুলিয়ে তাতে ছবি তোলা হতো। হোক না সাদা কালো, তাতে একটি ছবির জন্যই অধীর হয়ে বসে থাকতাম। আজ মোবাইলের দৌলতে প্রত্যেকের হাতেই ক্যামেরা। আর তাতেই বাড়ছে বিপদের ঝুঁকি।
নিজের ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার নেশা এ ভাবেই এক ধরনের মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে শুধু নিজের ছবি নিজের মোবাইলে কেমন দেখাচ্ছে, তাতেই মজে থাকা। যেন সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব! অনেক সময় আগে-পিছু অবস্থান দেখতে মানুষ ভুলে যায় ছবি তোলার উন্মত্ত ঝোঁকে। তার জন্য দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সেলফির ফাঁদে পড়ে বেঘোরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে গোটা বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশে। চলন্ত ট্রেন থেকে ঝুঁকে সেলফি তুলতে গিয়ে কেউ রেলের খুঁটির ধাক্কায় মারা গিয়েছেন। কখনও পাহাড়ের ধারে নিজস্বী তুলতে গিয়ে খাদে তলিয়ে গিয়েছেন কেউ। বিষধর সাপের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার নজিরও রয়েছে।
প্রায় প্রতি বছর বর্ষায় বোলপুরের শ্যামবাটি সেচ ক্যানালের খরস্রোতে পড়ে মৃত্যু হয় কোনও না কোনও তাজা প্রাণের। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ সেই বিপদসঙ্কুল স্থানে সেলফি তোলার কোনও বিরাম নেই। শ্যামবাটি থেকে প্রান্তিক যাওয়ার পথে ডান দিকে তাকালেই এই দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়বে। স্থানীয় মানুষ থেকে পর্যটক, প্রত্যেকেই সেই স্থানে ঝুঁকি নিয়ে নিজস্বী তোলেন হাসিমুখে। শ্যামবাটি থেকে সোনাঝুরি যাওয়ার পথেও এই ক্যানালেরই একটি খাদে অনুরূপ ভাবে সেলফি তোলার হিড়িক চোখে পড়ে।
সেলফির ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে মরে তা কে বা জানে! এই ভয়ানক ‘রোগ’ থেকে বাঁচা খুব শক্ত। কারণ নেশা থেকে মুক্তির উপায় নেশারুরা জানলেও জানতে চায় না।
লেখক সাহিত্যকর্মী ও কলেজশিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy