ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে গভীর রাতে বেআইনি ভাবে চলছে বনভোজন। নিজস্ব চিত্র
অরণ্যের দিনরাত্রি উপভোগ করতে ঝাড়গ্রামের জুড়ি নেই। শীত মানেই ঝাড়গ্রামে পর্যটনের মরসুম। ঝাড়গ্রামের পাহাড়-জঙ্গলের টানে দলে দলে পর্যটকেরা আসেন। কিন্তু জঙ্গলের নিয়ম না জানায় বিপদেও পড়তে হয়। বাইরে থেকে আসা অত্যুৎসাহীরা কখনও জঙ্গলের গভীরে হাতির ছবি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারান। কখনও আবার রাতে গভীর জঙ্গলে আলো জ্বালিয়ে, সাউন্ড-বক্স বাজিয়ে বনভোজনের নামে বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত তো করেনই, সেই সঙ্গে নিজেদের বিপদও ডেকে আনেন!
ঝাড়গ্রামের সংরক্ষিত শালজঙ্গল যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই জঙ্গলে হাতির পাশাপাশি, নেকড়ে, হায়না, বনশুয়োর, খেঁকশিয়াল, শিয়াল, বন-বিড়ালের মতো নানা প্রাণীও রয়েছে। আদিবাসী-মূলবাসীদের একটি বড় অংশ বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তাঁরা জঙ্গলের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও শালপাতা, শালবীজ, মহুল ফল সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায়ই হাতির মুখোমুখি হন। জঙ্গলে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গিয়ে প্রতি বছরই হাতির সামনে পড়ে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
বন দফতরের এক পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, গত পাঁচ বছরে কেবলমাত্র বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়েই বুনো হাতির আক্রমণে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে অবিভক্ত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। আর গত দু’বছরে ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে হাতির ছবি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ জন। এঁদের মধ্যে দু’জন স্রেফ বেড়াতে এসে শখে হাতির ছবি তুলতে গিয়ে নিজেদের বিপর্যয় ডেকে এনেছেন।
ঝাড়গ্রামের জঙ্গল দেখতে মনোরম। কিন্তু জঙ্গলের নিয়ম-কানুন না জানার ফলে পর্যটকেরা বন-বিধি ভাঙেন। এতে জঙ্গলের পরিবেশের ক্ষতি হয়। বন-বিধি অনুযায়ী সংরক্ষিত জঙ্গলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু সে সব কাগজে কলমেই রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তা সমীর মজুমদার জানাচ্ছেন, জঙ্গলমহলের বনবাসী মানুষজন বংশ পরম্পরায় জঙ্গলে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে দিন গুজরান করেন। বনবাসী মানুষজনের অকাষ্ঠ বনজ সম্পদ সংগ্রহ করার চিরাচরিত আধিকার রয়েছে। এবং স্থানীয় বনবাসী মানুষজন জঙ্গলের বন্যপ্রাণীদের আচার-আচরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও অসতর্ক মুহূর্তে অঘটন ঘটে যায়। কিন্তু যাঁরা বাইরে থেকে আসছেন, মূলত পর্যটকেরা জঙ্গলের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। বিপদ এখানেই লুকিয়ে রয়েছে।’’
বন-বিধি অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রাতের বেলা যাওয়ার অনুমতি নেই। বন দফতরের বিশেষ অনুমতিতে সূযোর্দয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জঙ্গলের নিরাপদ এলাকায় পর্যটকেরা যেতে পারেন। বন দফতরকে বিশেষ আর্থিক রেভেনিউ দিয়ে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ জন যেতে পারেন। সিনেমা-সিরিয়ালের শ্যুটিং ও জঙ্গল পরিদর্শনের জন্যই এমন অনুমতি দেওয়া হয়। জঙ্গলের ভিতরে আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ। সাউন্ড-বক্স বাজানোও নিষিদ্ধ। তাঁবু খাটিয়েও জঙ্গলে থাকাও আইন বিরুদ্ধ। এ সব না জানার ফলে পর্যটকেরা ভুল করেন। সেই ভুলের মাসুল অনেক ক্ষেত্রে দিতে হয়।
কয়েকদিন আগেই গভীর রাতে ঝাড়গ্রামের ঘৃতখামের গভীর জঙ্গলে বিনা অনুমতিতে জনা ৪৫ পর্যটক তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাসের আয়োজন করেছিলেন। জেনারেটরের আলো জ্বালিয়ে, সাউন্ড-বক্স বাজিয়ে বনভোজনে মেতে উঠেছিল পর্যটক দলটি। অথচ ওই জঙ্গলের আশেপাশেই ছিল ছ’টি বুনো হাতি। সে খবর অজানা ছিল পর্যটকদের। যে কোনও সময় বড় অঘটন ঘটার আশঙ্কা ছিল। স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ ও বনকর্মীরা গিয়ে ওই পর্যটকদের জঙ্গল থেকে বার করে নিয়ে আসেন। বনবিধি না জানায় পর্যটকেরা ভুল স্বীকার করায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই পর্যটকেরা বন-বিধি ভেঙেছিলেন। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতে পারত বন দফতর। কিন্তু কলকাতা থেকে আসা ওই দলে জনা ২০ মহিলাও ছিলেন। সতর্ক করে দলটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নভেম্বরের গোড়ায় হাওড়ার মৌড়িগ্রামের এক যুবক স্রেফ হাতির ছবি তোলার নেশায় ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইলের জঙ্গলে ঢুকেছিলেন। আগে কোনও দিন তিনি হাতি দলের মুখোমুখি হননি। দামি ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে হাতির ছবি তোলার সময় দলের একটি হাতি ওই যুবককে নাগালে পেয়ে শুঁড়ে জড়িয়ে মাটিতে আছড়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই যুবকটির মৃত্যু হয়। দামি ক্যামেরাটি পায়ে পিষে চুরমার করে দেয় হাতিটি। ঝাড়গ্রামের ডিএফও বাসবরাজ হলেইচ্চি বলেন, ‘‘বন ও বন্যপ্রাণ সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকায় পর্যটক ও বাইরে থেকে আসা লোকজন বিপদে পড়েন। অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায়।’’ ডিএফও জানান— জঙ্গলে হাতি ছাড়াও, নেকড়ে, সাপ ও অন্যান্য নানা বন্যপ্রাণী ও সরীসৃপ রয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে রাতে জঙ্গলে গেলে যে কোনও সময় বিপর্যয় ঘটতে পারে। এখন পর্যটনের মরসুম। পর্যটকদের অনেকেই জঙ্গলে যেতে চান। এই ভাবে জঙ্গলের কোর এলাকায় ঢুকে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের নামে তাঁরা নিজেদের বিপদ ডেকে আনেন।
পর্যটন দফতরের স্বীকৃত ঝাড়গ্রাম ট্যুরিজম সংস্থার কর্ণধার সুমিত দত্ত জানাচ্ছেন, কলকাতার অত্যুৎসাহী পর্যটকদের একাংশ জঙ্গলে যাওয়ার জন্য আগ্রহ দেখান। কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে যাওয়াটা যে ঝুঁকির এবং আইন বিরুদ্ধ সেটা বুঝিয়ে তাঁদের নিরস্ত করা হয়। সুমিত বলেন, ‘‘আমরা পর্যটকদের বাইরে থেকে জঙ্গল দেখাই। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এখন হাতির গতিবিধি অনেকটা বেশি বেড়ে গিয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহরেও একাধিক বার হাতি ঢুকে পড়েছে। তাই পর্যটকদের আমরা কোনও জঙ্গলেই যাওয়ার পরামর্শ দিই না। বরং হাতি সম্পর্কে সচেতন করি।’’ চলতি মরশুমে যে সব পর্যটক আসছেন, তাঁদের ভ্রমণের শুরুতেই জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ সম্পর্কে আগাম সতর্ক করা হচ্ছে বলে দাবি সুমিতের।
কয়েকদিন আগেই ঝাড়গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন কলকাতার বাসিন্দা রুনু বৈশালী, দিগন্ত দাস। রুনু বলেন, ‘‘আমরা জনাদশেক মিেল দল বেঁধে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল, কাছ থেকে জঙ্গল আর হাতির দলকে দেখব। কিন্তু শুনলাম এতে নাকি খুবই ঝুঁকি রয়েছে। তাই রাস্তার দু’পাশের জঙ্গল দেখেই আশ মেটালাম।’’
শীতের শেষে শুকোতে থাকে শালগাছের পাতা। তখন ঝরা পাতায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ফলে জঙ্গলের বনভূমির খুবই ক্ষতি হয়। শুকনো পাতায় দাউ দাউ করে আগুন ধরে যাওয়ার ফলে জঙ্গলের মাটির অনেক গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সরীসৃপ ও ছোট বন্যপ্রাণী মারা পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ সচেতনতার অভাবে পাতা পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে ঝরে যাওয়া শুকনো শালপাতায় আগুন ধরিয়ে দেন। সেই দেখাদেখি আবার পর্যটকেরাও ঝরা শালপাতায় আগুন ধরিয়ে ফেলেন। এর ফলে জঙ্গলের গাছেরও ক্ষতি হয়। জঙ্গল সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা না থাকায় কখনও স্থানীয়রা ভুল করে বন্যপ্রাণ ও পরিবেশের ক্ষতি করছেন, নিজেদেরও বিপদ ডেকে আনছেন। আবার পর্যটকেরাও জঙ্গলের মোহে ভুল করে ফেলছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy