Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
মার্কিন দেশের কালো-মানুষের কাহিনি কেন আমাদের চেনা ঠেকে

দমচাপা শোক, দুঃসহ স্মৃতি

আমাদের দেশে এখনও দলিত বা জনজাতি অবমাননার ইতিহাস থেকে অহং বানাতে সক্ষম হয়েছে কি? জাতপাতের নিগড় সুকঠিন।

টোনির আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি আমাদের জীবনে? বা আমাদের ইতিহাসে? 

টোনির আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি আমাদের জীবনে? বা আমাদের ইতিহাসে? 

ঈপ্সিতা হালদার
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

এক শিশুর বিষে আক্রান্ত ১৩৪ নম্বর বাড়ি। শিশুকন্যাটিকে তার মা গলা কেটে মেরেছে। আর আজ তার ছোট ছোট আঙুলের ছাপ এখানে ওখানে পড়ে থাকে। পড়শিরা একঘরে করেছে হত্যাকারী মা সেথে আর পরের মেয়ে ডেনভারকে। মা কালো, আমেরিকার দাসদের এক জন। তার বাড়িতে এক দিন আসে স্লেভ হাউসের আর এক দাস, পল ডি। আর এক দিন জল থেকে উঠে আসে নাম না-জানা এক মেয়ে, যে সেথে-কে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে, যেন-বা সদ্যোজাত। সে-ই ‘বিলাভেড’। মায়ের অসাড় পিঠে থাকে এক চোকচেরি গাছ। আসলে দিনরাত চাবকানোয় পিঠের চামড়া গুটিয়ে গাছের ছাল হয়ে গিয়েছে। এক দিকে স্লেভ হাউসের বিস্মৃতি, কারণ সন্তান জন্মের পর থেকেই মা-সন্তানের ছাড়াছাড়ি। সকল শিশুই পরিচয়হীন, পরিবারহীন। শিশুটি শুধু জানে ওই খেতে নুয়ে কাজ করতে থাকা পিঠগুলির মধ্যে মা আছে। মা বলে, আটখানা সন্তানের জন্ম দিয়ে সন্তান স্মৃতি বলতে শুধু মনে আছে বড় জন পোড়া রুটি খেতে ভালবাসত, ব্যস। কোনও সন্তানের মুখ মনে নেই। আর অন্য দিকে থাকে এই অসহনীয় ছেদ, লাগাতার ধর্ষণ, ঘুমহীন শ্রম আর অমানবিক শারীরিক অত্যাচারের স্মৃতি— ইচ্ছে করে ভুলে যেতে চাওয়া সেথে। না হলে সেই স্মৃতি টুঁটি টিপে রাখবে, তীক্ষ্ণ কাঁটা বিঁধিয়ে রাখবে চোখে, ঘুমোতে দেবে না, দাসপ্রথা আইন করে তুলে দেওয়ার পরও নতুন জীবন বাঁচা সম্ভবই হবে না।

টোনি মরিসন, এক জন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান লেখক, এ রকমই বলে চলেন তাঁর ‘বিলাভেড’ উপন্যাসে। তিনি কালের নিয়মে গত হয়েছেন। এই দূরতর ঘটনায় আমাদের শোকাকুল হওয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশে তুলনামূলক সাহিত্য ও ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যক্রমে তাঁর উপন্যাস পড়ানো হয়। কিন্তু আমেরিকার দাসপ্রথায় কালো মানুষদের ওপর অত্যাচারের দলিল ও সেই কালো মানুষদের জীবনের অন্তরিন আকাঁড়া সত্য, যা টোনির লেখায় ভয়াবহ মহিমায় বর্তমান, তা ছাড়া টোনির আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি আমাদের জীবনে? বা আমাদের ইতিহাসে?

না, টোনির উপন্যাস মার্কেসের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ বা অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অব স্মল থিংস’-এর মতো পাইরেটেড কপি হয়ে উৎসুক পাঠকের হাতে উঠে আসেনি আমাদের দেশে। কিন্তু তাঁর বই বিক্রি হয়েছে অজস্র, নিষিদ্ধ হয়েছে নানা জায়গায়, ১৯৯৩-তে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা লেখক হিসেবে তিনি নোবেল পাওয়ায় মানুষ উদ্বেল হয়েছে যেমন, ওই একই কারণে গঞ্জনা ও বিরোধিতা কিছু কম আসেনি সে সময়। যখন তিনি প্রকাশনা জগতে, গ্রন্থ সম্পাদনা করছেন, কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের সঙ্গে। আসলে কৃষ্ণাঙ্গ লেখকরা ষাটের দশক থেকে লিখলেও (‘জুবিলি’, মার্গারেট ওয়াকার, ১৯৬৬; ‘রুটস’, অ্যালেক্স হেলি, ১৯৭৬) টোনি মরিসনের লেখা ছাপা হওয়ার পর আমেরিকার সাহিত্যের দিকচিহ্নই বদলে যায়। অর্থাৎ, এক দিকে আছে আমেরিকার মূল সাহিত্য যা সাদাদের রচিত। আর কালোদের লেখা বলে একটা আলাদা বর্গ আছে যেখানে কালোরা কালোদের কথা বলে থাকে, এটা থেকে সরে কৃষ্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতাকে আমেরিকার সাহিত্যের অন্যতম সারবত্তা বলে ভাবা শুরু হয়। স্বীকার করার দরকার হয় যে আমেরিকার প্রতিটি বাড়ি আসলে ভূতগ্রস্ত, কারণ তা কোনও না কোনও ভাবে কালো মানুষের নিপীড়নের দায় এবং এমনকি মৃত্যুশোক বহন করছে। ‘বিলাভেড’ সেই বদ্ধ শোকের আখ্যান। আফ্রিকা থেকে মানুষদের ধরে গায়ে গনগনে লোহা দিয়ে স্ট্যাম্প মেরে অতলান্তিক পেরিয়ে পাচার করে আনা হত আমেরিকায়, আর তার পর চলত অকথ্য শারীরিক মানসিক অত্যাচার, স্লেভ হাউসে। ‘ষাট মিলিয়ন ও আরও’…অতলান্তিক পেরোনো কালো মানুষরা যারা দাসে পরিণত হল, তাদের সংখ্যা এ ভাবেই লেখা থাকে ‘বিলাভেড’-এর শুরুতে। আর নানা সময়, স্বর, প্রজন্ম, প্রেক্ষিত, নানা জনের ভয়াবহ অত্যাচারের স্মৃতি, স্মৃতিলোপ একের সঙ্গে অন্যে মিলে মিশে থাকে, আর তার পুনরুদ্ধার চলতে থাকে।

‘বিলাভেড’ উপন্যাসটির সন্তান-হত্যাকারী মা সমূলে কাঁপিয়ে দেয় মাতৃত্বের সংজ্ঞাকে, কারণ সে নিজ শিশুকন্যাকে হত্যা করে তাকে দাসের জীবন থেকে মুক্তি দিতে, পাশবিক অত্যাচার, অমানুষিক খাটুনি, নিরন্তর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ থেকে রেহাই দিতে। মৃত্যু ছাড়া দাসের পালাবার পথ নেই এ কথা জেনে। বাস্তব জীবন থেকে টোনির উপন্যাসে উঠে আসা এই হত্যাসূত্র নারীবাদকে নতুন করে দেখতে শেখায় যে, নারী হলেই নারীত্ব-মাতৃত্ব এক নয়, সব মহিলা একে অপরের সহেলি, এ রকম কখনও হয় না। সেই নারী কালো চামড়ার হলে, তার অবদমন ও যৌন নিপীড়ন কালো চামড়ার আফ্রিকান নারী ও দাস হওয়ার কারণেই।

আর, সেই গরম লোহার ছাপ্পা, ক্ষতের ওপর উপর্যুপরি চাবুকের ও জীবনব্যাপী ক্ষুধার স্মৃতির পুনরুদ্ধার করতেই হবে। না হলে, আমেরিকায় কালো মানুষ তার ইতিহাসের বাইরে পড়ে থাকবে। নিজেকে শুশ্রূষা করার পথ মানে নিজের দুঃসহ স্মৃতিকে ভোলার চেষ্টা নয়। নিপীড়নের স্মৃতিকে মনে না রাখলে নিজের পরিচয় জানা হবে না, এক দিন এক জন প্রাক্তন দাস বা তার সন্ততিরা বলে উঠতে পারবে না যে, ‘আমার অহংকার আমি কালো মানুষ’ বলে। বর্ণবিদ্বেষ যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবচেতনে নিহিত, এ কথা না বোঝার কোনও কারণ নেই। না বোঝার কারণ নেই যে সেই সমাজের চোখে চোখ রেখে অহং অর্জন করা কতখানি কঠিন।

জাতপাতের বৈষম্য আর অত্যাচারে বিদীর্ণ আমাদের দেশে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কালো মানুষের ওপর বর্ণবৈষম্যবাদী সাদাদের সন্ত্রাস না বোঝার কথা নয়। ভোলা সম্ভব নয় যে রাজস্থানের ভাঁওরি দেবী থেকে উন্নাওয়ের কিশোরীটি, সব ক্ষেত্রেই ধর্ষক ছিল উঁচু জাতের পুরুষ। উঁচু জাতের পুরুষের ধর্ষণ আসলে কেবল নারীর ওপর যৌন অত্যাচার নয়, তা অচ্ছুৎকে ‘অকাত’ শেখানোর অস্ত্র। জাতপাতের কারণেই আমাদের দেশে ‘জাস্টিস’ বা সুবিচার সুকঠিন হয়ে যায়। সত্যের মুখ চাপা পড়ে যায় গভীর অতলে। পয়ঃপ্রণালীর পাঁক ও পুরীষ যাদের দিয়ে বংশানুক্রমে তোলানো হয়, তারা বিষবাষ্পে দমবন্ধ হয়ে মরলেও অনেক নীচে সত্যের মুখ নিষ্কাশন করতে পারে না।

কাজেই শাসন ত্রাস অবমাননার বিপরীতে কালো মানুষের যে অহং অর্জনের কথা টোনি বলে চলেছেন, সে রকম ভাবে ছোট জাত বলে আমার অহং, আদিবাসী বলে আমার অহং, এ ভাবে ভাবার সুযোগ বা সময় কোনওটাই আমাদের দেশে এসেছে কি? না, আসেনি। আর ঠিক সে জন্যই টোনি মরিসন আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক।
এক সাক্ষাৎকারে টোনি বলেন, তাঁর প্রজন্মের ছিল বর্ণবৈষম্যের ইতিহাসকে অর্জনের দাবি, যাতে কালো মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয়ের ইতিবৃত্ত লেখা যেতে পারে। এখন তাঁর পরের পরের প্রজন্মের কাছে গায়ের কালো রং পরিচয় হিসেবে মুখ্য নয় আর। মুখ্য হল— মানুষটি জীবনে কী কী বেছে নিয়েছেন নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য। টোনি বলেন, কালো মানুষের আত্মোদ্ধার প্রসারিত হয়েছে অনেক দূর।

আমাদের দেশে এখনও দলিত বা জনজাতি অবমাননার ইতিহাস থেকে অহং বানাতে সক্ষম হয়েছে কি? জাতপাতের নিগড় সুকঠিন। প্রসঙ্গত মনে পড়ে সদ্য দেখা ‘আর্টিকল ফিফটিন’ ছবিতে আন্ডারগ্রাউন্ডে লুকোনো দলিত নেতার ক্ষোভ, ‘‘আমরা হরিজন আর বহুজন হয়েই রইলাম, জনগণর জন আর হতে পারলাম কই?’’

তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Tony Morison Arundhuti Roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy