Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
আজ পণ্ডিত রবিশঙ্করের শততম জন্মদিন

অন্য কিছুর খোঁজে?

বাংলার রেবা রায়চৌধুরী, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় রায়, ট্রামশ্রমিক তালবাদ্যশিল্পী দশরথলাল, মহারাষ্ট্র গুজরাতের শান্তা গাঁধী, দীনা গাঁধী, রেখা জৈন, কাইফি আজমি, শওকত আজমির সঙ্গে সেখানে তখন যোগ দিয়েছেন উদয়শঙ্করের আলমোড়া সেন্টার থেকে শান্তি বর্ধন, শচীন শঙ্কর, নরেন্দ্র শর্মা, অবনী দাশগুপ্ত। এই স্কোয়াড-এ বেশি দিন ছিলেন না রবিশঙ্কর।

ছবি: গেটি ইমেজেস

ছবি: গেটি ইমেজেস

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৫৫
Share: Save:

পণ্ডিত রবিশঙ্কর কোথাও বোধ হয় স্পষ্ট করে বলেননি, ঠিক কেন ১৯৪৩ সালে আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার বন্ধ হয়ে যেতেই তিনি তাঁর প্রিয় ‘দাদা’র সঙ্গ থেকে নিজেকে যেন কিছুটা বিচ্যুত করেই, রেবা রায়চৌধুরীর স্মৃতিতে (রেবা রায়চৌধুরী, জীবনের টানে শিল্পের টানে, কলকাতা: থীমা, ১৯৯৯)— ‘‘১৯৪৫-এর শেষে কি ’৪৬-এর গোড়ায় হঠাৎই রবিশঙ্কর আমাদের স্কোয়াডে যোগ দিলেন, উদয়শঙ্করের আলমোড়া কেন্দ্র ভেঙে যাবার পর সস্ত্রীক আন্ধেরীর সহজ সরল জীবনের মাঝখানে চলে এলেন। রবিশঙ্কর আলাউদ্দিন খাঁ-র কন্যা অন্নপূর্ণাকে বিবাহ করেছেন। এমন অমায়িক গুণী মহিলার সংস্পর্শে আমি কোনও দিন আসিনি। রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণা বউদির সাত-আট ঘণ্টা একনাগাড়ে একাত্ম হয়ে রেওয়াজ শুনবার পর নিজেদের তিরস্কার করতাম। মাঝে মাঝে রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণা বউদি চাঁদের আলোয় বসে সেতার বাজাতে বাজাতে সারা রাত কাবার করে দিতেন। মাঝখানে শুয়ে ঘুমোত শিশুপুত্র শুভ, তাঁদের একমাত্র সন্তান।... রবিশঙ্কর যখন প্রথম এসেছিলেন, তখন সে কী অবস্থা। তাঁর থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার জায়গা নেই। তখন এই রকমই একটা ঘরে রবুদা থাকতেন, স্ত্রী আর একটা বাচ্চা ছেলে নিয়ে। নিজের কাপড় নিজে কাচছেন, বাসন মাজছেন। অনেক সময় আমরাও বাসনকোসন মেজে দিতাম। এই রকম একটা সিম্প্ল লাইফ।’’

‘স্কোয়াড’ বলতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কালচারাল স্কোয়াড। তার শিল্পীরা মুম্বইয়ের আন্ধেরির এক পরিত্যক্ত বাংলোয় একসঙ্গে ‘কমিউন’ জীবন যাপন করেন। বাংলার রেবা রায়চৌধুরী, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় রায়, ট্রামশ্রমিক তালবাদ্যশিল্পী দশরথলাল, মহারাষ্ট্র গুজরাতের শান্তা গাঁধী, দীনা গাঁধী, রেখা জৈন, কাইফি আজমি, শওকত আজমির সঙ্গে সেখানে তখন যোগ দিয়েছেন উদয়শঙ্করের আলমোড়া সেন্টার থেকে শান্তি বর্ধন, শচীন শঙ্কর, নরেন্দ্র শর্মা, অবনী দাশগুপ্ত। এই স্কোয়াড-এ বেশি দিন ছিলেন না রবিশঙ্কর। কিন্তু এই স্কোয়াড-এর যে অনুষ্ঠানগুলি তখন পরিবেশিত হয়েছিল, তার সূচনা হত রবিশঙ্করের সুরে বাঁধা ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা’ গানটির সমবেত গায়ন দিয়ে, সেই সুরটিই আজ এই গানটির প্রচলিত সুর। ইকবালের রচনাটির আদি গজল ধাঁচের কোমল আলুলায়িত সুরটি এক বার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কাছে শুনবার সুযোগ হয়েছিল। ‘স্কোয়াড’-এর আবেগ ও ‘কমিউন’ জীবনযাত্রার মধ্যে মেহনতি মানুষের জীবনযাপনের রুক্ষতার অনুভব তথা তাড়না শুধু ‘সারে জঁহা’-র সুরেই নয়, ‘স্কোয়াড’-এর প্রথম প্রযোজনা ‘ভারতের মর্মবাণী’ থেকে দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘অমর ভারত’ বা ‘ইন্ডিয়া ইমমর্টাল’-এ লোকপরম্পরার সঙ্গে ধ্রুপদী সঙ্গীতধারার মেলবন্ধনে ধরা পড়েছিল।

আলাউদ্দিন খাঁর কাছে তাঁর শিক্ষা তখনও চলেছে, কিন্তু তিনি কি তখনই খুঁজতে শুরু করেছেন ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যের পরিমণ্ডলের শুদ্ধতার সংস্কারের বাইরে উত্তর-ঔপনিবেশিক মুক্ত ভারতের কাঙ্ক্ষিত সঙ্গীতচর্চার এক লক্ষ্যকল্প? সেন্ট্রাল স্কোয়াডই ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে প্রথম এই লক্ষ্যকল্পটি পরীক্ষাপ্রয়াসের ব্যাপ্তির মধ্যে নিয়ে এসেছিল, নির্মাণে ও পরিবেশনায়। আন্ধেরির ‘কমিউন’ জীবনের দৈনন্দিন ‘অসুবিধা’র টানাপড়েন প্রথাগত ‘শিল্পসাধনা’র তেমন অনুকূল ছিল না, তাই রবিশঙ্কর ‘স্কোয়াড’ ছেড়ে আইএনটি-র ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র প্রযোজনার সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু সারা জীবনই ওই লক্ষ্যকল্পটি থেকে যায়— ধ্রুপদী ভারতীয় সঙ্গীতচর্চার ঘরবন্দি দরবারি আবহটাকে কেমন করে বিস্তৃত করা যায়! স্বাধীনতার পর নেহরু-রাধাকৃষ্ণন-কেলকরের সাংস্কৃতিক নীতি ও তার রূপায়ণেও সেই লক্ষ্যকল্প ছিল। সঙ্গীত নাটক অকাদেমির পত্তন ও রেডিয়ো সঙ্গীত সম্মেলন-সহ আকাশবাণীর নানা ঐতিহাসিক উদ্যোগে নবোদ‌্গত জনগণতন্ত্রে ‘হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস ছিল।

নাট্য, সঙ্গীত, নৃত্য, উৎসবের যে অতীত ঐক্য নানা ঐতিহাসিক দোলাচলে কালচক্রে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে লোকরুচি-সমাদরেও বিভাজন-দূরত্ব রচনা করেছে, সাংস্কৃতিক বামপন্থার সেই উন্মেষকালে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ও সেন্ট্রাল স্কোয়াডের কর্মসূচিতে তার মধ্যে জোড় লাগানোর যে অনুচ্চারিত প্রণোদনা: তা-ই কি আজীবন রবিশঙ্করকে প্রাণিত করেছিল? তাই কি ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘জেনেসিস’-এর মতো চলচ্চিত্রে, ‘অঙ্গার’ নাটকে কিংবা তাপস সেন, খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে ‘অসম্পন্ন’ শিশুতীর্থ আলোকধ্বনি প্রকল্পে তাঁর যোগদান?

তাই বলে কাজটা যে সহজ ছিল, তা-ও নয়। এই এতগুলি শিল্পসংরূপের ঐতিহাসিক বিভাজনে প্রত্যেকটির মধ্যেই যে স্বাতন্ত্র্য-সংস্কারের পরম্পরা তৈরি হয়ে গিয়েছে, তা ভেঙে নতুন করে জোড় লাগাতে গেলে সমস্যা হয় বইকি! দূরদর্শনে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারের আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি-মতবিনিময়ে আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করি যে তাঁর সময়ের সর্বাগ্রগণ্য তিন যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে প্রথম দিকের ছবিগুলিতে কাজ করার পর তিনি কেন তাঁদের পরিহার করে নিজেই নিজের ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নিলেন, তাতে তিনি যে তিনটি কারণ বলেছিলেন, তার একটিমাত্র তিনি ‘আনুষ্ঠানিক’ সাক্ষাৎকারে উচ্চারণ করেছিলেন: আধুনিক নাগরিক বাস্তবের রূপায়ণে তিনি ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের কোনও স্থান খুঁজে পাননি! অন্য দু’টি অনুল্লেখিত কারণের মধ্যে একটি ছিল চলচ্চিত্রে ‘সঙ্গীত পরিচালনা’র যথার্থ চারিত্রের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। সত্যজিৎবাবু আমায় সে দিন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, বিদেশি ছবির কৃতজ্ঞতা-স্বীকৃতি লিপিতে কী ভাবে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, সঙ্গীতবাদক তথা বাদ্যবৃন্দ, বাদ্যবৃন্দ পরিচালকের নাম ও ভূমিকা আলাদা আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট হয়! সেই বিচারে প্রথম থেকেই তাঁর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক যথার্থই কে, প্রশ্নটি বিতর্কিত থেকে যায়।

সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ধ্রুবপদ’ পত্রিকার পথের পাঁচালী বিষয়ক সঙ্কলন (২০০৬)-এ সঙ্কলিত তথ্যাবলি থেকে, সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর আর সুব্রত মিত্রের লিপিবদ্ধ সাক্ষ্য থেকে যে কাহিনিটা বেরিয়ে আসে, তাতে দেখা যায়, ভবানী সিনেমায় রবিশঙ্কর প্রথম ছবিটির রাশেজ় দেখেন— ‘‘ঐ রাশেজ় দেখেই আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম।... তার পরেই সমস্তটা দুম করে ঠিক হয়ে গেল। আরেকটা দিন একটু ছবিটা দেখলাম। পরে পুরো একদিনের জন্য স্টুডিও নেওয়া হল। আমার মনে হয় ছবিটার সুরের কাজের পুরো সময়টা মাত্র চার কি পাঁচ ঘণ্টার। লোকজন ছিল, ধরুন, ছয় কি সাত জন।’’ সুব্রত মিত্রের সাক্ষ্য, ‘‘এ ছবির সব মিউজ়িক রেকর্ডিং এক রাত্রেই হয়েছিল... ওই এক রাত্রেই সমস্ত মিউজ়িক কমপোজ় করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং হল আর রবিশঙ্কর আবার বিদেশ ফিরে গেলেন। পরে এডিট করতে গিয়ে দেখা গেল দু’জায়গায় মিউজ়িক কম পড়ছে। তখন হাতের কাছে আমাকেই ধরা হল।... ছবিতে মিষ্টিওয়ালার দৃশ্যগুলিতে যেখানে সেতার আর গুপিযন্ত্র বাজছে, সেই সুরটা আমি কমপোজ় করে সেতারে বাজিয়েছিলাম।’’

এই দ্রুততার মধ্যে যে ভাবে কাজটা হয়েছিল, সত্যজিৎবাবুই যে দৃশ্যগুলিতে আবহসঙ্গীতের আয়োজন আছে, তা স্থির করে নিয়ে সেই অংশগুলি আলাদা করে পণ্ডিতজিকে দেখিয়ে নেন (যে দেখার কথা তিনি নিজে উল্লেখ করেছেন), কী ‘মুড’ তিনি চান, তাও বলে দেন, কখনও কখনও রাগও প্রস্তাব করেন। ওই অংশগুলির জন্য প্রয়োজনের হিসেবের চেয়ে একটু বেশি সময়ই রবিবাবু বাজিয়ে দেন, সহকারীদের নিয়ে। যেমন ফড়িংয়ের নাচের দৃশ্যটি তখনও ছবির অন্তর্গত হয়নি, ‘থিম’ আবহের জন্য রেকর্ড করা একটি ভেরিয়েশনেই দৃশ্যের আবহ সৃষ্টি হয়ে যায়। সত্যজিৎবাবুর কথায় ‘কাটিং রুম-এই’।

কিন্তু সত্যজিৎবাবুর অকুণ্ঠ স্বীকৃতি, ‘পথের পাঁচালী’র মূল থিমটি রবিশঙ্করের মতে ‘‘এসে গেছল ছবিটা দেখবার আগেই। এ নিঃসন্দেহেই ইন্সপায়ার্ড। অন্য দুটি ছবিতেও আছে তেমনই ইন্সপায়ার্ড কয়েকটি সাংগীতিক রচনা, যেমন অপরাজিত-য় রাগ যোগ-এ ধারিত সেই আবেগোচ্ছ্বাস যা ফেটে পড়ে হরিহরের মৃত্যুতে। ওই একই রচনা লেগে থাকে ছবির শেষ দিকে সর্বজয়ার নৈঃসঙ্গ্যে। তেমনই অপুর সংসার-এ অপু-অপর্ণার সম্পর্কের ব্যঞ্জনায় বেদনার্ত লাচারি টোড়ি।’’

আবার মৃণালবাবু বিপদে পড়েন ‘জেনেসিস’-এ। সভ্যতার আদি কালে স্থাপিত ছবিতে নীরবতার যে কাঙ্ক্ষিত নৈঃসঙ্গ্য তা কখনও কখনও রবিশঙ্করের আবহোচ্ছ্বাসে ধাক্কা খাওয়ায় মৃণালবাবু সম্পাদনাকালে তা বাদ দেওয়ায় এক মধ্যরাতে রবিশঙ্করের ফোনে ক্ষুব্ধ তিরস্কারে প্রচণ্ড আহত হন: ‘‘আমি কমপোজ়র। আমার কমপোজ়িশন-এ হাত দেওয়ার কোনও অধিকার আপনার নেই!’’

শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎবাবুর সেই অমোঘ সতর্কবাণীই স্মর্তব্য: ‘‘আসল কথা সুরকারকে মনে রাখতে হবে যে তাঁর আনুগত্য প্রধানত চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি, সংগীতশাস্ত্রের প্রতি নয়।’’ (শারদীয় দেশ, ১৯৬৪)

অন্য বিষয়গুলি:

Birthday Musician Pandit Ravi Shankar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE