Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

বাংলা মডেল

এই স্বীকৃতির বিপদও আছে। ইহাই যে উন্নয়নের একমাত্র মডেল নহে— বস্তুত, ‘গুজরাত মডেল’-এর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়াইয়াও যে আরও অনেক পথে উন্নয়নচিন্তা সম্ভব— এই স্বীকৃতি সেই কথাটিকে ভুলাইয়া না দেয়।

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:২৭
Share: Save:

দারিদ্র দূরীকরণের হারে দেশে সর্বাগ্রে পশ্চিমবঙ্গ। গোটা দেশের গ্রামাঞ্চলে যে সময়কালে দারিদ্রের হার বাড়িয়াছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র কমিয়াছে ছয় শতাংশ-বিন্দু। বহুচর্চিত, বহুপ্রশংসিত মডেল মান্য করা গুজরাতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র হ্রাস হইয়াছে দ্রুততর হারে। গুজরাতের সহিত পশ্চিমবঙ্গের তুলনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অল্প কথায় বলিলে, গুজরাত যাহা নহে, পশ্চিমবঙ্গ ঠিক তাহাই। রাজনীতি বা সামাজিক প্রশ্নেই নহে, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও— এবং, বর্তমান আলোচনায় অর্থনীতিই বিবেচ্য। গুজরাত মডেলের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে রহিয়াছে বিপুল শিল্পায়ন— যে কোনও মূল্যে শিল্পায়ন— এবং, তাহা হইতে চুয়াইয়া পড়া সমৃদ্ধির সূত্রেই উন্নয়নের প্রত্যাশা। অন্য দিকে, বাংলার শিল্পহীনতা প্রশ্নাতীত। এই রাজ্যে উন্নয়ন দাঁড়াইয়া আছে বিভিন্ন গোত্রের সরকারি সহায়তার উপর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়া থাকেন, জন্ম হইতে মৃত্যু, এবং তন্মধ্যবর্তী জীবনের সকল ধাপের জন্যই এই রাজ্যে কোনও না কোনও সরকারি প্রকল্প আছে। তাহাকে দানসত্র বলিলে দানসত্র— কিন্তু, পরিসংখ্যান বলিতেছে, দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে এই মডেলটি যথেষ্ট কার্যকর হইয়াছে। ঘটনা হইল, বৃহৎ শিল্পহীন পশ্চিমবঙ্গ আয়ের অঙ্কে খুব পিছাইয়া নাই। রাজ্যওয়াড়ি মোট আয়ের সারণিতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ষষ্ঠ। আর্থিক বৃদ্ধির হারও নিতান্ত ফেলনা নহে। এবং, আয়ের অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গ হইতে বহু আগাইয়া থাকা মহারাষ্ট্রে যখন দারিদ্রের হার বৃদ্ধি পাইতেছে, গুজরাতেও দারিদ্র হ্রাসের হার পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় শ্লথ, তখন ‘বাংলা মডেল’-কে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। দারিদ্র দূর হইয়াছে বলিয়াই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় ‘শ্রী’ প্রকৃত প্রস্তাবে শ্রীময়, অথবা সব খয়রাতই গ্রহণযোগ্য, তেমন দাবি করিবার প্রশ্নই নাই। কিন্তু, তাঁহার আর্থিক নীতিকে ‘খেয়ালখুশি’ অথবা ‘তোষণ’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ারও যে উপায় নাই, ইহাও যে আর্থিক উন্নয়নের একটি মডেল হইতে পারে, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানই তাহা জানাল।

তবে, এই স্বীকৃতির বিপদও আছে। ইহাই যে উন্নয়নের একমাত্র মডেল নহে— বস্তুত, ‘গুজরাত মডেল’-এর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়াইয়াও যে আরও অনেক পথে উন্নয়নচিন্তা সম্ভব— এই স্বীকৃতি সেই কথাটিকে ভুলাইয়া না দেয়। ‘বাংলা মডেল’-এর প্রথম সমস্যা, তাহার কুশলতা প্রশ্নাতীত নহে। অর্থাৎ, যদি শুধু দারিদ্রের প্রশ্নটিকেও দেখা হয়, তবে সরকার সমপরিমাণ টাকা খরচ করিলে এই মডেলে দারিদ্র যতখানি কমে, অন্য কোনও মডেলেই তাহার তুলনায় দারিদ্র হ্রাসের পরিমাণ বেশি হইতে পারে না, এই কথাটি বলা চলিবে না। বরং আশঙ্কা হয়, ‘বাংলা মডেল’-টি অকুশলী। যে হেতু ইহা এক গোত্রের ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর উপর দাঁড়াইয়া আছে, ফলে অকুশলী হইবার অনেকগুলি সম্ভাবনা থাকিয়া যায়। এক, যাঁহাদের হাতে টাকা পৌঁছাইলে দারিদ্র সর্বাপেক্ষা কমিতে পারে, টাকা তাঁহাদের হাতে না-ই পৌঁছাইতে পারে। দুই, এই মডেলে ‘কাটমানি’-র অনুপাত অধিকতর হইবার সম্ভাবনা প্রবল, ফলে প্রকৃত জনদের হাতে তুলনায় কম টাকা পৌঁছাইবে। এই কথা দুইটির সত্যতা রাজ্য ইতিমধ্যেই জানে। এই মডেলের দ্বিতীয় সমস্যা, তাহা সম্পূর্ণত সরকারি টাকার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, সরকার যত ক্ষণ অবধি খরচ করিতে পারে, এই মডেলও তত ক্ষণই চলিবে। সরকারের যদি টাকার অভাব না থাকে, তবে চিন্তা নাই। কিন্তু, অমিত মিত্র মহাশয়ও স্বীকার করিবেন, রাজকোষের অবস্থা ভাল নহে। গোটা দেশেই রাজস্ব আদায়ে টান পড়িয়াছে, পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নহে। তদুপরি, জিএসটি-র টাকা লইয়াও কেন্দ্রের গয়ংগচ্ছ ভাব। ফলে, ‘বাংলা মডেল’ এখনও অবধি কার্যকর হইলেও তাহার বিকল্প সন্ধান করা ভাল। সেই মডেলের অর্জিত সাফল্য ধরিয়া রাখিবার জন্যই।

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Mamata Banerjee Poverty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy