আমেরিকার নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল জানার অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে এক জন টুইট করেছিলেন, “ইয়ে ইলেকশন হ্যায় কি বজরংবলী কে পুছ? খতমই নহি হো রহা হ্যায়?” ভারতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার গতির পাশে আমেরিকায় এই বিলম্বিত লয় অবাক করে। প্রশ্ন হল, ভারতের ভোটগণনার দ্রুততা কি কেবলই ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, না কি এর মূল্য গুনছেন অন্য কেউ?
আমেরিকার নির্বাচন ব্যবস্থা কেবল ভোটের দিনে একটি নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে শারীরিক ভাবে উপস্থিত নাগরিকদের ভোট গোনে না। যাঁরা সে দিন সেখানে উপস্থিত থাকবেন না, তাঁদেরও মতপ্রকাশের অবকাশ দেয়। আমেরিকার পাঁচটি রাজ্যে সম্পূর্ণ নির্বাচনই হয় ডাকযোগে। অন্য রাজ্যগুলিতেও সব ভোটারের অবকাশ আছে ডাকযোগে বা ভোটের দিনের আগেই ভোট দেওয়ার। ২০১৬-তে ৩৪% ভোট পড়েছিল এই বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে, এ বার পড়েছে ৬৮%। ডাকে-আসা ভোট বেশ কিছু ধাপের মধ্যে দিয়ে যায় ভোটারের পরিচিতি ইত্যাদি সুনিশ্চিত করতে, যেটা সময়সাপেক্ষ। ফলাফলের সরকারি ঘোষণায় তাই এত সময় লাগে। ট্রাম্প উঠেপড়ে লেগেছিলেন এই বিকল্প ব্যবস্থায় বাগড়া দিতে। যেমন, ডাক বিভাগের বরাদ্দ আটকে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, কাজের জন্য নির্বাচন এলাকার বাইরে-থাকা শ্রমজীবীদের একটা বড় অংশ তাঁর নীতিকে সমর্থন করেন না।
ভারতে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছিল ৬৭.৪%, পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়েছিলেন মাত্র ০.৪%। উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো যে সব রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক বেশি, সেখানে ভোটদান জাতীয় গড়ের থেকে কম। বিহারে ২০১৯-এ ভোট দিয়েছিলেন ৫৭.৩%, এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৫৭.০৫%।
যাঁরা ভোট দিলেন না তাঁরা কারা? গবেষকরা বলছেন, যাঁরা জীবিকার খোঁজে বাইরে, তাঁদের বড় অংশ ভোট দিতে পারছেন না। ভোটের সময়ে ঘরে ফেরার অবকাশ বা অর্থ নেই তাঁদের। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন দাবি তুলেছে যে, পরিযায়ী শ্রমিকদেরও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে দেওয়া হোক। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনের মতো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্বাচন পদ্ধতি মাথায় রাখলে দাবিটি অযৌক্তিক মনে হয় না।
আইনগত ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের পোস্টাল ব্যালট, প্রক্সি ভোটিং, বা আর্লি ভোটারের অধিকার দিতে কোনও অসুবিধা দেখি না। ‘রিপ্রেজ়েন্টেশন অব পিপলস অ্যাক্ট’-এর ধারা ২০ অনুযায়ী, যিনি যেখানে ‘সাধারণ ভাবে বসবাস করেন’, তিনি সেই এলাকার ভোটার। ‘সাধারণ ভাবে বসবাস’-এর জন্য নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকতেই হবে, এমন নয়। যিনি ফুটপাতে রাত্রিযাপন করেন, তিনি যদি সেখানে নিত্য রাত কাটান, তা হলে তিনিও ওই এলাকার ভোটার।
‘সাধারণ ভাবে বাস’ না করেও কারা ভোট দিতে পারবেন, তার তালিকা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে আইন সংশোধন করে। বর্তমানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা, রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল, স্পিকার প্রমুখ পদাধিকারী, যাঁরা কর্মসূত্রে বা পড়াশোনা করতে বিদেশ গিয়েছেন, কিন্তু সে দেশের নাগরিকত্ব নেননি, তাঁরা তালিকায় আছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের এই সুবিধা দিতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে না। রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলেই যথেষ্ট।
প্রশ্ন ওঠে, কাজের জন্য শ্রমিকরা যেখানে আছেন, সেখানেই ভোট দেন না কেন? মুশকিল হল, এঁরা অনেকেই আজ এক জায়গায় কাজ করেন তো কাল আর এক জায়গায়। ‘সাধারণ ভাবে বসবাস’ করেন না কোথাও। দ্বিতীয়ত, অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে কাজ করা পরিযায়ীরা অনেক সময়ে স্থানীয় শ্রমজীবীদেরও চক্ষুশূল হন। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের তাই মাথাব্যথা থাকে না এই ‘বহিরাগত’দের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে সাহায্য করার।
প্রায় তিন কোটি অনাবাসী ভারতীয়ের জন্য পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করতে ‘রিপ্রেজ়েন্টেশন অব পিপলস অ্যাক্ট’-এর একটি সংশোধনী বিল আনা হয়েছিল ২০১৭ সালে। সেই বিলে যে সব পদ্ধতিগত উদ্ভাবনের প্রস্তাব ছিল, সেগুলি পরিযায়ীদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হতে পারে। প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ওয়াই এস কুরেশি মনে করছেন, পরিযায়ী শ্রমজীবীদের জন্যে এই বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনা করা উচিত। ইলেকশন কমিশনের ‘স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ২০১৬-২০২৫’ পরিযায়ী মজুরদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছে, যদিও বিশদে কিছু বলেনি।
নির্বাচন পরিচালনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম, পরিযায়ীদের এই সুবিধা দিতে গেলে কী ধরনের পরিবর্তন হতে পারে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। কাজটা শুরু হবে বুথ স্তর থেকে, মানে বুথ স্তরের অফিসারদের চাপ বাড়বে। জেলা স্তরের নির্বাচনী অফিসগুলিতে পোস্টাল ব্যালট সেল-এর আকার বহু গুণ বাড়াতে হবে। বুথ স্তরের ব্যবহার্য ভোটার তালিকার ‘ওয়ার্কিং কপি’ তৈরির কাজ অনেকটা বেড়ে যাবে। পোস্টাল ব্যালট গুনতেও সময় বেশি লাগবে। বিকেলের মধ্যে জয়-পরাজয় স্পষ্ট করা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু এই ব্যবস্থা না থাকলে পরিযায়ীদের একটা বড় অংশ গণতন্ত্রে অংশ নিতে পারবেন না।
আমেরিকায় নির্বাচন ব্যবস্থা যদি ভারতের মতো হত, তা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো টিকে থাকতেন নিজের আসনে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই তাই এই পরিমার্জন দরকার।
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy