—প্রতীকী চিত্র।
বহুত্বের ভাবনা এই দেশে স্বাভাবিক, অনিবার্য। এতগুলি ভাষা, এতগুলি ধর্ম ও উপধর্ম কোন ভূখণ্ডেই বা রহিয়াছে? নানাত্ব লইয়াই এই দেশের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিশিয়া থাকেন। পার্থক্যকে বিভেদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার অপসংস্কৃতিটি এই দেশের সাধারণ মানুষের সহজাত নহে। তবু রাজনীতির স্বার্থে এই নানাত্বকে কলুষিত করার প্রয়াস চোখে পড়ে। নানাত্বের উপর আঘাত নামিয়া আসে, চোখে পড়ে রাজনৈতিক ছলা। আশ্চর্য এই যে, নানাত্বকে খর্ব করার সঙ্গে সঙ্গে আবার স্থানিকতার হুজুগে হাওয়া দেওয়াও সমানে চলে। যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। যাঁহারা হিন্দু-ভারতের কল্পনা উস্কাইয়া তুলেন, হিন্দুত্বের গর্বে বলীয়ান হইয়া নানাত্বকে হরণ করেন, সাংস্কৃতিক বহুত্বকে অস্বীকার করেন, তাঁহারাই আবার মধ্যে মধ্যে বঙ্গসংস্কৃতির পালে বাতাস দিবার অক্ষম ছলায় মত্ত হন। তাঁহাদের এই ছদ্মপ্রচেষ্টার পদে পদে লজ্জাহীনতা। তাঁহারা রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান কোথায় জানেন না, ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র তাঁহারা সাম্প্রদায়িক বিভেদ-সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করেন, তাঁহাদের কুলাচার্যরা বাংলা শিখিবেন বলিয়া হাঁক পাড়েন। রাজনৈতিক বক্তৃতার মাঝে বঙ্গদেশে দু’কলি বাংলা শব্দ যোগ করিয়াই তাঁহারা ‘গুরুবর’-এর বাংলার অন্তরে প্রবেেশর সাধ রাখেন। ভাবেন, এই ভাবে হিন্দু বাঙালিদের মন জয় করিয়া তাহার পর একমাত্রিক হিন্দুত্বের নদীতে বিচিত্র বাঙালিকে ডুবাইয়া মারিলেই কার্যসিদ্ধি। এমন আশা তাঁহাদের পক্ষে স্বাভাবিক, তবে আমবাঙালি মোটের উপর বুঝিয়াছেন এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক অপপ্রচেষ্টার রূপটি। বাংলার রূপ ও মনটি না বুঝিয়া বঙ্গভাষা কথন, বঙ্গসংস্কৃতি যাপন যেন মিথ্যা ভেংচির সমান।
অবশ্য এমন মনোযোগহীনতা ভারতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল না। একদা ভারতীয় নায়কেরা এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্বকে অনুধাবন করিতে তৎপর হইতেন। তাহা ভেংচি নহে, অমনোযোগীর ছদ্মপ্রয়াস নহে; তাহা যথার্থই রাজনৈতিক দায়িত্ব। গাঁধী বিদেশ হইতে এই দেশে ফিরিলেন। বুঝিলেন দেশের মানুষের স্রোতে অবগাহন করিবার জন্য স্বদেশি ভাষাই প্রকৃত অবলম্বন। জীবনের শেষ পর্বে গাঁধী যখন বঙ্গদেশে দাঙ্গা আটকাইবার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অগ্রসর হইতেছেন, তখনই পাশাপাশি চলিতেছিল তাঁহার বঙ্গভাষা শিক্ষা। স্লেট আর খড়ি লইয়া রপ্ত করিতেছেন বাংলা হরফ। অনশনরত মহাত্মা মঞ্চে বসিয়া আছেন, নীরবে স্লেটে অভ্যাস করিতেছেন বাংলা অক্ষরমালা, এই দৃশ্য সেই দিন বঙ্গদেশ প্রত্যক্ষ করিয়াছিল। ভারতের একতার ব্রত লইয়া দাঁড়াইয়া অহিংসার, পারস্পরিকতার ও বহুত্বের ভাষা যাপন করিতেছিলেন যিনি, তাঁহাকে শেষ অবধি যে-পক্ষের আততায়ীর গুলিতে মরিতে হইল, সেই পক্ষই আজ ভারতের একতার নামে ধ্বজা উড়াইতে ব্যস্ত— ইহাই সংবাদ।
কেবল অন্য প্রদেশের নেতারাই বা কেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বুঝিয়াছিলেন সর্বভারতীয় স্তরে সংযোগ স্থাপন করিতে হইলে তাঁহাকে ভাল ভাবে হিন্দি ভাষা রপ্ত করিতে হইবে। হিন্দি কথনে বিশেষ মনোযোগ দিয়াছিলেন তিনি। রাজনীতির বলয়ের বাহিরেও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন বঙ্গীয় মনীষীরা অপর ভারতীয় ভাষাশিক্ষার চর্চা করিতে দ্বিধা করিতেন না। ক্ষিতিমোহন সেন উত্তম রূপে হিন্দি শিক্ষা করিতেন। ভারতীয় সন্তসাহিত্যের ধারা সেই ভাষাতেই চর্চা করিয়াছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও এই ধারার বাঙালি। অন্য প্রদেশের উপর বঙ্গীয় ভাষার আধিপত্যের বিরোধিতা করিয়াছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। এক ভাষার সহিত অপর ভাষা বিনিময়ের সম্পর্ক তাঁহাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখনকার নেতারা অবশ্য ভুলিয়া গিয়াছেন, অপরের ভাষা রপ্ত করিতে গেলে কী ভাবে বিনীত অধ্যবসায়ে নিয়োজিত করিতে হয় নিজের মন-প্রাণ। তাঁহারা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থসাধনের একটি প্রকল্প হিসাবে ভাষার বুলিকথন চাহেন। ক্রমাগতই ‘অপরের সংস্কৃতি জানি’ বলিয়া হাস্যকর ও আপত্তিকর রকমের বিকৃত শব্দ ও বাক্য আওড়াইয়া থাকেন। মনে রাখেন না যে, শিক্ষা যদি করিতেই হয় তাহা হইলে শ্রমদান আবশ্যক। শ্রমে কী না হয়! কৃত্তিবাসের দস্যুরত্নাকর মরা বলিতে বলিতে রাম বলিয়াছিল। হিন্দুত্বের স্বঘোষিত নেতারা যদি বাংলা শিখিবার শ্রম করিয়া সেই পথে প্রকৃত বহুত্বের স্বাদ পান, কে বলিতে পারে, তাহাতে তাঁদের উগ্র মন বদলাইতেও পারে। সত্যকারের ভাষাশিক্ষার মাধ্যমে মনোজগতের উপর সংস্কৃতির প্রলেপ পড়িলে তাহার সৌরভ বহু দূর যাইতে পারে। সংস্কৃতি এক আশ্চর্য বস্তু, তাহার উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy