সম্ভাবনা: হাথরসের ঘটনার প্রতিবাদে যন্তর মন্তরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ। ২ অক্টোবর, নয়াদিল্লি। পিটিআই
সারুবাই যে বাড়িতে কাজ করতেন, সুরযকে সেখানে কিছুতেই যেতে দিতেন না তিনি। এক দিন লুকিয়ে লুকিয়েই তাঁর পিছু পিছু সেখানে হাজির হল সে। ঢুকে দেখে, দিদিমা বাড়ির শৌচালয় সাফ করছেন। নাতিকে দেখে সারুবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন— কী কাজ করেন সেটা তাকে জানাতে চাননি তিনি। কিন্তু নাতি কেন বাধ্যতে। তো, একটু পরেই বালক জানাল, তার খুব বাথরুম পেয়েছে। প্রথমটায় তিনি বলে দিলেন, এখানে হবে না। তার পর নাতির করুণ মুখখানা দেখে মায়া হল, সন্তর্পণে তাকে যথাস্থানে নিয়ে গেলেন। বাড়ির ভিতরে নয়, তার কোনও প্রশ্নই নেই, বাইরের লোকজনের ব্যবহারের জন্য একটা শৌচালয় ছিল, এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন নাতিকে। এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে। এবং দিদিমা জল ঢেলে বেরিয়েই দেখলেন— দরজার ও-ধার থেকে বাড়ির একটি মহিলা তাঁদের দেখছে। একটু পরেই বাড়ির মালকিনের কাছে ডাক পড়ল। যে সব গালাগালি তার শ্রীমুখ থেকে নিক্ষিপ্ত হল, তার অনেক শব্দই দশ বছরের সুরযের জানা ছিল না, কিন্তু তাতে তার আতঙ্ক আর অপমান এক ছটাকও কম হয়নি— ‘‘আমি সিঁটিয়ে গিয়ে মুখটা লুকোনোর চেষ্টা করছিলাম।’’ হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের শোরেনস্টাইন সেন্টার-এর গবেষক সুরয ইয়েংড়ে লিখেছেন, ‘‘এই ঘটনা আমাকে আমার দলিত সত্তাটি চিনিয়ে দিয়েছিল।’’ শিশু সে-দিনই বুঝে নিয়েছিল, তার স্থান উঁচু জাতের মলমূত্র ফেলার জায়গাটির চেয়েও নীচে।
মহারাষ্ট্রের নান্দেড়-এর দলিত পরিবারের সন্তান সুরযের বয়েস এখন একত্রিশ। দলিত-চর্চার ভুবনে তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্রুত। তাঁর লেখা কাস্ট ম্যাটারস (পেঙ্গুইন) আত্মজীবনী নয়, কিন্তু নিজের জীবনকে মন্থন করে রাজনীতি-ভাবনার দলিল। জ্ঞান হওয়ার মুহূর্ত থেকে সেই জীবন তাঁকে শিখিয়েছে যে তাঁর স্থান, তাঁর স্বজনবান্ধবের স্থান মহান ভারতের ত্রিশ কোটি অন্ত্যেবাসীর দুনিয়ায়, সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ হওয়ার সাত দশক পরেও যারা উচ্চবর্ণের বহু মানুষের চোখে তাদের শৌচালয়ের থেকেও অশুচি। তিনি নিজের জীবনে সফল, কৃতবিদ্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সাফল্য তাঁকে পরিতৃপ্ত করেনি, তাঁর চেতনাকে প্রখরতর করেছে। জ্ঞানচর্চা এবং জীবনচর্যার টানাপড়েনে তৈরি সুরযের সুতীক্ষ্ণ আত্মবোধ ঘোষণা করে: ‘‘আমি মানুষ নই, আমি দলিত। আমি সহকর্মী নই, আমি দলিত। আমি বন্ধু নই, আমি দলিত।’’ এই উচ্চারণের গভীরে আছে কয়েক হাজার বছরের নিপীড়ন। সেই ঐতিহ্য আজও সমানে চলেছে। হাথরসের দলিত জননী তাঁর যন্ত্রণাদীর্ণ কন্যার রক্তাক্ত নিম্নাঙ্গ ঢেকে দেওয়ার জন্য কাপড় খুঁজেছেন, তার কয়েক দিন পরে সেই কন্যার মৃতদেহ পুলিশের হেফাজতে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে, মা একটি বার মেয়ের মরা-মুখও দেখতে পাননি।
হাথরসের ঘটনা পৈশাচিক, কিন্তু অকল্পনীয় তো নয়ই, অভাবনীয়ও নয়, বরং এমন আরও অনেক পৈশাচিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যে সমাজে ক্রমাগত এই পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, হিংসা তার মজ্জায় মজ্জায়। হিংসার উৎকট প্রকাশ দেখে আমরা (কখনও কখনও) শিহরিত হই, কিন্তু ভিতরের রূপটি খেয়ালও করি না। অথচ খেয়াল করলেই ধরা পড়ে, প্রকৃত গরল কোন আধারে সঞ্চিত।
যেমন, হাথরসেই প্রাথমিক প্রতিবাদ বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চবর্ণের মাতব্বরদের সৌজন্যে কিছু দৃশ্যের জন্ম হল, যার অন্তর্নিহিত হিংস্রতা— অন্তরে নিহিত বলেই— অতলস্পর্শী। তেমনই এক দৃশ্যে দেখা গেল, উঁচু জাতের একটি পালোয়ান-সাইজ়ের স্থানীয় নেতা তর্জনগর্জনের ফাঁকেই মোলায়েম গলায় বলছে: ‘দলিত কি দলিত নয় সে-সব কোনও ব্যাপার না, আমার কাছে সবাই এক, অন্যায় হলে তার প্রতিকার করব, কিন্তু এই নিয়ে ভাগাভাগির রাজনীতি বরদাস্ত করব না।’ স্পষ্টতই, সে এতদ্দ্বারা জানিয়ে দিতে চায়: পায়ের নীচে থাকার কথা যাদের, তারা প্রতিবাদের স্পর্ধা দেখাতে এলে শেষ করে দেব। বস্তুত, এই নির্ভেজাল হুমকির ভাষাও সে-দিন তার শ্রীমুখে শোনা গেছে। কিন্তু ‘আমার কাছে সবাই এক’ বলে আশ্রয়দাতাও সাজতে চেয়েছে সে। তার কারণ, সে জানে, সমাজে এই ভাষার স্বীকৃতি আছে।
আর সেই স্বীকৃতির উৎসে আছে ক্ষমতার কাঠামোয় আশ্রিত সামাজিক স্থিতাবস্থার অনুমোদন। আমরা ক্ষমতাবানের গুন্ডামির নিন্দে করি, কিন্তু ক্ষমতার কাঠামোটাকে অন্যায় বলে মনে করি না। আমাদের আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতাবানেরা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করে মানবিকতার মৌলিক এবং শাশ্বত আদর্শ মেনে চলবেন, যে মানবিকতা নিজেকে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত ইত্যাদি সমস্ত বিভাজনের ঊর্ধ্বে দাঁড় করিয়ে বলে: সবার উপরে মানুষ সত্য।
সবার উপরে সত্য হয়ে উঠতে পারে এমন মানুষ-এর সমাজ যদি কখনও তৈরি হয়, তার সঙ্গে আলাপ করা যাবে’খন, কিন্তু আপাতত এই সোজা কথাটা সোজা করে বুঝে রাখা ভাল যে, মানুষ নামক কোনও মৌলিক বা শাশ্বত ধারণা নেই, মানুষ তার সামাজিক অবস্থানের সাপেক্ষেই নিজেকে পরিচিত করতে পারে। সেই অবস্থানের বেঁধে দেওয়া গণ্ডি অস্বীকার করে অন্যতর পরিচিতি খোঁজার চেষ্টাও নিশ্চয়ই করতে পারে সে, কিন্তু অবস্থানটাকে উড়িয়ে দিতে পারে না। জাতপাতের হিংস্র সমাজকাঠামোটির মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘জাতপাত মানি না, সব মানুষ সমান’ বলে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইলে সেই নিষ্ক্রিয়তাই হয়ে উঠবে ওই কাঠামোটিকে ধরে রাখার হাতিয়ার। রক্তাক্ত হাতিয়ার। শত বার ধুয়েও সে-রক্ত মোছা যাবে না, তার স্রোত অবিরাম শুনিয়ে চলবে: আমি মানুষ নই, আমি দলিত। এই বাস্তবকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি দিয়েই ভীমরাও অম্বেডকর ‘জাতপাতের বিলোপসাধন’-এর দাবি তুলেছিলেন।
সেই দাবির সূত্র ধরে সুরয ইয়েংড়ে বলেছেন ‘দলিত ইউনিভার্সালিজ়ম’-এর কথা: ‘‘দলিত সর্বজনবাদ দাবি করে জাতপাতের সম্পূর্ণ বিলোপসাধন, যার ফলে তৈরি হবে এক নতুন সমাজ, যেখানে নিপীড়িত মানুষ সার্থক জীবন খুঁজে পাবে— রবিদাসের কল্পিত সেই বেগমপুরা।’’ পাঁচশো বছর আগে সন্ত রবিদাস এমন এক জনপদের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে দুঃখ নেই, কারণ দলিতেরা সেখানে মুক্ত, তাই সবাই মুক্ত। সুরযের বক্তব্য: জাতপাতের কাঠামোটাকে ভেঙে না ফেললে সেই মুক্তি অসম্ভব। এবং তিনি মনে করেন, এই মুক্তির সংগ্রামে উচ্চবর্ণের মানুষ শরিক হতে পারে, তার মধ্যে দিয়ে নিজেকে এই সমাজকাঠামোর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারে, কিন্তু নেতৃত্ব দিতে হবে দলিতকেই, কারণ সে এই সমাজের প্রধান শিকার, তার স্থান উচ্চবর্ণের শৌচালয়েরও নীচে।
এই প্রকল্পের ভাবনা অনিবার্য ভাবে মনে পড়িয়ে দেয় বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চালিত মার্ক্সীয় রাজনীতির কথা। সুরয সেই রাজনীতির সমর্থক নন, কারণ সেখানেও উচ্চবর্ণের আধিপত্যই বহাল থেকেছে। এই অভিযোগ অসত্য নয়— এ দেশের বামপন্থী রাজনীতির তত্ত্বে, কর্মসূচিতে এবং সংগঠনে সচরাচর শ্রেণিসংগ্রামের একমাত্রিক ধারণার চাপে জাতপাতের প্রশ্নকে বাস্তবিকই গৌণ বা অবান্তর বলে এক প্রান্তে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে সেই রাজনীতিরও বড় ক্ষতি হয়েছে। পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বামপন্থীদের নতুন ভাবনা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দলিতের রাজনীতি যদি আজ বামপন্থীদের দূরে সরিয়ে রেখে তার ‘নিজের সংগ্রাম’-এর পথে এগোতে চায়, সেটাও কি একই গোত্রের ভুলের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠবে না? সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে দলিতের ভূমিকা অবশ্যই প্রয়োজনীয়, বস্তুত অপরিহার্য, কিন্তু তা যে যথেষ্ট নয়, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতেই তার দগদগে প্রমাণ হিসেবে বিরাজ করছেন মূর্তিমতী মায়াবতী, তাঁর টুইট-সর্বস্ব নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে।
এই নিষ্ক্রিয়তার বিপরীতে, হাথরসের ঘটনাটিকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী ও সংগঠনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সমাবেশের যে স্বতঃস্ফূর্ত সক্রিয়তা দেখা গেল, তা এক নতুন রাজনীতির সম্ভাবনাকে কয়েক পা এগিয়ে দিয়েছে। তাকে বলতে পারি সংযোগের রাজনীতি। জাতপাতের কাঠামো ভেঙে দলিত মানুষের মুক্তি এবং পুঁজিতন্ত্রের কাঠামো ভাঙতে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য— এই দুই লক্ষ্যের পারস্পরিক সংযোগ সাধন একই সঙ্গে জরুরি ও সম্ভব। জরুরি, কারণ ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র এবং তার অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি দু’টি কাঠামোকেই আরও জোরদার করে তুলতে বদ্ধপরিকর। সম্ভব, কারণ দলিতের বঞ্চনার সঙ্গে শ্রমজীবীর বঞ্চনা উত্তরোত্তর এক স্রোতে মিশছে— কান্না ঘাম রক্তের স্রোত। এবং, অবশ্যই, ক্রোধের। দলিত সাহিত্যের অন্যতম যুগন্ধর ওমপ্রকাশ বাল্মীকি বলেছিলেন, দলিত সত্তা হল ‘কোটি কোটি অচ্ছুতের ক্রোধের প্রকাশ’। আপাতত সবার উপরে সত্য এই ক্রোধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy