সাইকেল সফরে পর্যটকেরা। ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে। নিজস্ব চিত্র
গত জুনে ইথিয়োপিয়া সরকার জাতীয় সাইকেল নীতি ঘোষণা করেছে। সরকার চাইছে, নাগরিকেরা আরও হাঁটুন আর সাইকেল চড়ুন। বছর দুয়েক ধরে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে। এর বহুমুখী কারণ। সাইকেল বেশি মানে গ্রিন হাউস গ্যাস কম। বায়ুদূষণ কম। পরিবেশ রক্ষা। ফলে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি। আবার রাস্তায় গাড়ি কমলে ট্রাফিকের সমস্যা নেই। দুর্ঘটনা কম। দূষণে এবং দুর্ঘটনায় প্রতি বছর বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে।
পরিবেশ ভাবনা থেকেই পুজোর মুখে ঝাড়গ্রাম জেলায় চালু হয়েছে সাইকেল-পর্যটন। পর্যটকেরা সাইকেলে বনপথ উজিয়ে দেখছেন গ্রামীণ-জীবন ও সংস্কৃতি। গাড়ির ঘেরাটোপের বাইরে পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি যোগ তাঁদের। পর্যটন দফতর স্বীকৃত ‘ঝাড়গ্রাম ট্যুরিজম’ সংস্থার তত্ত্বাবধানে জেলার ১২টি হোম স্টে এই পরিষেবা চালু করেছে। সাইকেলের জন্য অবশ্য কোনও অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে না। তবে সাইকেলে গাইড নিলে আলাদা ভাড়া।
জেলায় সাইকেল পর্যটন শুরুর একটা গল্প আছে। ‘ঝাড়গ্রাম ট্যুরিজম’-এর কর্তা সুমিত দত্ত জানাচ্ছেন, কলকাতার কসমেটিক সার্জন অরুণ গঙ্গোপাধ্যায় এক দশক ধরে ঝাড়গ্রামে বেড়াতে আসেন। সাইকেলেই সফর করেন তিনি। দু’চাকায় ভর করেই ঝাড়গ্রামের জনজীবন ও প্রকৃতির বহু তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সুমিত বলেন, ‘‘মূলত ওই চিকিৎসকের সাইকেল ভ্রমণের সূত্র ধরে জেলায় আমরা সাইকেল-ট্যুরিজম চালু করেছি। জেলায় গোটা ১২ হোম স্টে রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সাতটি জেলা প্রশাসনের পর্যটন বিভাগের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সব ক’টি হোম স্টেতেই সাইকেল পাওয়া যাচ্ছে।’’ ঝাড়গ্রামের নকাট গ্রামের ‘চেতনা ইকো ভিলেজ হোম স্টে’-র মালিক শুভাশিস দেবসিংহ জানালেন, সাইকেলে বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে খুশি পর্যটকেরা। বেশিরভাগই মোবাইল ফোনে গুগল ম্যাপ দেখে এলাকার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন লোকশিল্পীদের গ্রামে। কেউ চিল্কিগড়ের কনক অরণ্যে। বেলপাহাড়ির কাঁকড়াঝোরের হোম স্টে-র মালিক প্রদীপ মাহাতো বলেন, ‘‘পর্যটকেরা সাইকেলে চড়াই-উতরাইয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছেন।’’
করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে মার খেয়েছিল ঝাড়গ্রামের পর্যটন ব্যবসা। আনলক পর্বে ফের আসছেন পর্যটকেরা। পুজোর মরসুমে বেশির ভাগ হোটেল ও হোম স্টে-র অগ্রিম বুকিং হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু, পুজোর মুখে চালু হয়েছে হাওড়া-ঝাড়গ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেন পরিষেবা। ঝাড়গ্রামের জঙ্গল-পাহাড়-নদী-ঝর্না বহুদিন থেকেই আকর্ষণীয়। ‘জ্যোৎস্নাস্নাত উদার বন-প্রান্তর আমার সামনে। ফিরবার ইচ্ছে নেই’— ঝাড়গ্রামের সৌন্দর্যে আপ্লুত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় দিনলিপিতে লিখেছিলেন। সত্তরের দশকে ‘চারমূর্তি’ ছবির শ্যুটিংয়ে কাঁকড়াঝোরে এসে জঙ্গল-প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন অভিনেতা চিন্ময় রায়। হালে দু’দফায় ঝাড়গ্রামে বেড়িয়ে গিয়েছেন কৌতুক অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু। তিনি জানালেন, ঝাড়গ্রামের প্রকৃতি তাঁকে বারবার টেনে আনে। পরিবেশের ক্ষতি না করে পর্যটনের প্রসার হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সাইকেল ট্যুরিজম ঝাড়গ্রামে দরকার বলে মনে করেন পরিবেশ কর্মীরাও। পরিবেশকর্মী অপরাজিতা ষড়ঙ্গী বলেন, ‘‘সাইকেল ট্যুরিজম বিষয়টা বেশ ভাল। এতে দূষণহীন ভ্রমণে পর্যটকেরা স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়ে সমৃদ্ধ হবেন। অন্যদিকে, হস্তশিল্পী ও গ্রামবাসীও তাঁদের সামগ্রী সরাসরি পর্যটকদের কাছে বিক্রির সুযোগ পাবেন।’’ সুমিতও বলছেন, ‘‘সাইকেল-ভ্রমণে পরিবেশও বাঁচবে, সেই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’’ এমনিতে নানা কারণে ঝাড়গ্রামের বনভূমি কমছে। এর পর দূষণের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তা সমীর মজুমদার একটু সতর্ক করলেন, ‘‘সাইকেল-ভ্রমণের বিষয়টি খুবই ভাল। তবে জঙ্গলের রাস্তায় উপযুক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বা গ্রামীণ গাইড নিয়েই বেড়ানো উচিত। কারণ, জঙ্গলে হাতি ও বন্যপ্রাণী রয়েছে।’’
সাইকেলে বেড়ানো রোমাঞ্চকর বলে মনে করছেন সায়নদীপ ঘোষ, কণিশ দাশ, ওমজিৎ আগরওয়ালের মতো তরুণ পর্যটকেরা। ওমজিৎ বলেন, ‘‘সাইকেলে বেলপাহাড়ি ঘোরার সময়ে শিমূলপালে গিয়ে শিল্পীদের পাথরের মূর্তি, থালা-বাটি তৈরি দেখে দারুণ লেগেছে। পাথরের বাটিও কিনেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy