যাহা অখণ্ড মণ্ডলাকার, যাহার দ্বারা চরাচর ব্যাপ্ত, রসিক কমলাকান্ত বলিয়াছিলেন সেই বস্তুটি ব্রহ্ম নহে, মুদ্রা। বঙ্কিমচন্দ্রের কাল গিয়াছে, এখন মানসজগৎ তথা আর্থিক পরিমণ্ডল অধিকার করিয়া বসিয়াছে অ্যাপ। কখনও কম্পিউটার, কখনও মোবাইল ফোন দ্বারা বাহিত হইয়া অ্যাপ ব্যক্তির করতলে আসিয়া পড়ে, এবং কত না বিচিত্র কার্য করিয়া ফেলে। করোনাভাইরাস মহামারি বেশ ভাল করিয়া বুঝাইল,সরকারও এখন অ্যাপ-এর ভিতর দিয়া ভুবন দেখিতেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী দেশের উদ্দেশে ভাষণে জনতার সাতটি কর্তব্যের একটি “আরোগ্য সেতু” অ্যাপ ডাউনলোড করিয়া রাখা। নিজেকে এবং অপরকে বাঁচাইতে এই অ্যাপ ব্যবহার করিতে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিলেন, ভিনরাজ্যে আটকাইয়া পড়া শ্রমিকদের অনুদান পাইতে হইলে ‘স্নেহের পরশ’ অ্যাপ-এর মাধ্যমে আবেদন করিতে হইবে। চাষিষের কৃষিপণ্য পরিবহণে সহায়তা পাইতে হইলে ‘অন্নদাত্রী’ অ্যাপ-এর দ্বারাই তাহা করা সম্ভব। রাস্তায়-ঘাটে বিপদে পড়িলে মেয়েদের কোনও একটি অ্যাপ ব্যবহার করিয়া সহায়তা চাহিবার পরামর্শ দিতেছে পুলিশ। এমন অ্যাপ-সর্বস্বতা প্রশ্ন না তুলিয়া পারে না। তাহা এই যে, অ্যাপ প্রভৃতি ডিজিট্যাল প্রযুক্তিকে অ-বিকল্প করিয়া তুলিবার সিদ্ধান্ত কি ঠিক? কেহ যদি স্বেচ্ছায়, স্বনির্বাচিত ভাবে ডিজিট্যাল দুনিয়া হইতে দূরে থাকিবার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁহার সেই অধিকার থাকিবে না কেন? যাঁহারা ডিজিট্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করিতে চান, তাঁহারা করিতে পারেন। কিন্তু সরকারি সহায়তায় সকলের সমান এবং শর্তহীন অধিকার। তাহার আবেদনে ডিজিট্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করিবার বিষয়টি নীতিগত সমর্থন পাইতে পারে কি? বিশেষত ডিজিট্যাল দুনিয়ার যে রূপ আমরা দেখিতেছি, তাহা খুব আশ্বাসজনক নহে। কোন অ্যাপ নিরাপদ, তাহা জানিবার উপায় নাই। তথ্যতস্কর কোন গোপন কথা জানিতেছে, হ্যাকার কখন সঞ্চয় শূন্য করিতেছে, কে সেই আতঙ্কে দিন কাটাইবে?
কথাটিতে যুক্তি আছে। ডিজিটাল দুনিয়া সুরক্ষিত নহে, অ্যাপ-এর ব্যবহার ব্যক্তির রুচিকর ও সুবিধাজনক না-ও হইতে পারে। কিন্তু মানবসমাজের নিয়মই এই যে, তাহা গরিষ্ঠের অভ্যাস দ্বারা পরিচালিত হয়। আজও অনেকে ফাউন্টেন পেন-এ কালি ভরিয়া লিখিতে পছন্দ করেন, কিন্তু সরকারি বা ব্যবসায়িক কাগজপত্র বলপেন দিয়া ভরিতে বলা হয়। অনলাইনে ফর্ম ভরিয়া গ্রামের ছাত্রছাত্রীরাও আজ করিতেছে, সামান্য-শিক্ষিত মানুষও মোবাইল ব্যবহার করিয়া ট্রেনের টিকিট কাটিতেছেন। নূতন প্রযুক্তি আসিয়া দাঁড়াইলে তাহাকে গ্রহণ করিতে অনেকের মনেই নানা আশঙ্কার উদয় হয়। সবাক চলচ্চিত্র শুরু হইলে চার্লি চ্যাপলিন হতাশ হইয়াছিলেন, সাংবাদিকরা টাইপরাইটার ব্যবহার শুরু করিলে ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন আর্নস্ট হেমিংওয়ে। নিঃশব্দ অভিব্যক্তিই সেরা কি না, কাগজ-কলমের আঁচড়ে অক্ষর ফুটাইলে ভাষায় অধিক প্রাণসঞ্চার হয় কিনা, তাহা লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে। কিন্তু সবাক হইয়া চলচ্চিত্রের ক্ষতি হয় নাই, সাংবাদিকতার মান কম্পিউটার ব্যবহারে কমে নাই। হয়তো এক দিন কলমে লিখিবার মতোই সহজ হইবে অ্যাপ-এর ব্যবহার। তাহাতে নৈতিক সঙ্কট কিছু নাই।
তবে প্রযুক্তিতে সকলের যেহেতু সমান অধিকার নাই, তাই সামাজিক অন্যায়ের আশঙ্কা যথেষ্টই। বিশেষত অ্যাপ-এর জন্য প্রয়োজন স্মার্টফোন। তাহা সুলভ নহে। অনলাইনে আবেদন করিতে হইলে জোরালো ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। ভারতে আজও সর্বত্র নেট-পরিষেবা সমান নহে। এই সকল কারণে যদি দরিদ্র মানুষ এই অধিকার হইতে বঞ্চিত হন, তাহার সান্ত্বনা নাই। তাই প্রথম পর্যায়ে অ্যাপ-নির্ভর আবেদনের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা, ক্ষেত্রবিশেষে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা বাঞ্ছনীয়। নচেৎ প্রযুক্তির ব্যবহারে অসমানতা সামাজিক অসাম্যকে আরও গাঢ় করিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy