বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে এই মুহূর্তে ভৌতিকতার ছায়া। ছবি: পিক্সাবে
গত দু’বছরের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে দু’টি ইন্দ্রপতন ঘটে গিয়েছে। অদ্রীশ বর্ধন এবং মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও এই দুই ব্যক্তিত্বের বিচরণক্ষেত্র ছিল পৃথক, তবু দু’জনের একটা জায়গায় মিলও ছিল। দু’জনেই ছিলেন অনুবাদক। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি হিসেবেও খ্যাতি ছিল। অদ্রীশ বর্ধন ছিলেন বিচিত্রকর্মা। মৌলিক লেখালেখির পাশে তাঁর করা অনুবাদের সংখ্যাও বড় কম নয়। মানবেন্দ্রর অনুবাদের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে যাকে ‘মননশীল সাহিত্য’ হিসেবে দেগে দেওয়া যায়, তা-ই। তুলনায় অদ্রীশ অনুবাদ করেছেন পশ্চিমের জনপ্রিয় সাহিত্যকে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, মানবেন্দ্র জুল ভার্ন অনুবাদ করেছিলেন। সেই সঙ্গে বিস্তর কল্পবিজ্ঞান কাহিনিও তাঁর হাত দিয়ে বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছেছিল। অনুবাদের সংখ্যা বিচার করলে এই দুই ব্যক্তিত্বই ছিলেন মহারথী। আর তাঁদের করা অনুবাদ সমূহের বড় অংশটিই ‘শিশু-কিশোর’ সাহিত্যের সীমানার বাইরে। বিদেশি জনপ্রিয় সাহিত্যের বিবিধ লেখালেখি তাঁদের হাত দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছে। কৈশোরে নিজের অজান্তেই বাঙালি পাঠকের কম করে দু’টি প্রজন্ম পরিচিত হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের বিশেষ কিছু ধারার সঙ্গে, বিশেষ করে হরর, আনক্যনি, রহস্য-রোমাঞ্চ ও কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে।
অদ্রীশ বর্ধন একা হাতে এডগার অ্যালান পো থেকে শার্লক হোমস, জুল ভার্ন থেকে কল্পবিজ্ঞানের বাঘা বাঘা লেখকদের রচনা বাংলায় তুলে এনেছিলেন। রোমাঞ্চ-কাহিনির প্রতি তাঁর যে একটা আন্তরিক টান ছিল, সে কথা তিনি আকাশবাণী কলকাতার এফএম প্রচারতরঙ্গে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বিশদ ভাবে জানিয়েওছিলেন। কাহিনির টানেই তিনি অনুবাদ করতেন, লেখকের খ্যাতি বা বাংলার পাঠক সেই লেখককে আদৌ কতটা চেনে, তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। বলাই বাহুল্য এর ফল পাওয়া গিয়েছিল হাতেনাতে। অন্তত দুই প্রজন্মের বাঙালির কৈশোরে ঢুকে পড়েন জনপ্রিয় কোনান ডয়েল থেকে সেই সময়ে এই ভূমিতে একেবারে অজ্ঞাত আমেরিকান লেখক হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্রাফট। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বাঙালি পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পোল্যান্ডের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক স্তানিশোয়াভ লেমের। মানবেন্দ্রও অনুবাদ করেছেন অ্যালান পো, কোনান ডয়েল। সব মিলিয়ে বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যে ভিনদেশি রচনাকে প্রবেশ করানোর কৃতিত্বে এঁরা অগ্রণী হয়েই থাকবেন।
আজ থেকে বছর চল্লিশেক আগেও কলকাতা এবং মফস্সলে লাইব্রেরি কালচার একটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল। সেই সময়কার লাইব্রেরিগুলির বাৎসরিক বই কেনার তালিকায় বেশ উপরের দিকেই থাকত জেমস হ্যাডলি চেজ বা আগাথা ক্রিস্টির বই। অবশ্যই বঙ্গানুবাদে। কপিরাইটের পাঁচিল টপকে কী ভাবে সেই সব বই সেই সময়ে বাংলায় অনূদিত হয়েছে, সেটা একটা রহস্য বটে। আজকের জনপ্রিয় বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদকর্মে এমন রোমাঞ্চ দেখা যায় না। তা হলে এখন অনুবাদটাই বা কী হয়? মানবেন্দ্র বা অদ্রীশ বর্ধনের লেখালেখির সোনার সময়টা পেরিয়ে গিয়েছে অন্তত পক্ষে তিনটি দশক আগে। ক্রমে দু’জনের লেখাই কমে আসে। বিশেষ করে অদ্রীশ বর্ধনের। কিন্তু তার পর বাংলা জনপ্রিয় অনুবাদ সাহিত্যের কী হল— এই প্রশ্ন সংগত ভাবেই মনে আসে।
গত দুই দশকে বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যে অনুবাদ ব্যাপারটা যেন একটু থমকে রয়েছে। ইটালির ইতালো ক্যালভিনো অথবা জাপানের হারুকি মুরাকামির মতো মননশীল লেখকের রচনা বাংলায় অনূদিত হলেও বিদেশি জনপ্রিয় সাহিত্যের অনুবাদে খনিক ভাটা লক্ষণীয় ছিল। সেই শূন্যস্থানটা গত বছর কয়েকের মধ্যে পূরণের একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। কিন্তু কী ধরনের লেখা অনুবাদ হচ্ছে বাংলায়? কারাই বা হাতে তুলে নিয়েছেন অনুবাদের কলম?
গত কয়েক বছরে বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যের চলতি হাওয়া অতিলৌকিক। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অলৌকিক গল্পকে আলাদা বইতে প্রকাশ করা হয়েছে, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের অলৌকিক গল্পের সংকলন নতুন করে আবার ছাপা হয়েছে। পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে জগদীশ গুপ্তের গা ছমছমে রসের গল্প। পাশাপাশি অতিলৌকিক কাহিনি রচনায় কলম ধরেছেন একঝাঁক তরুণ। থ্রিলার বা গোয়েন্দা কাহিনিতেও নতুন মুখ উঁকি দিচ্ছে। এমতাবস্থায় পশ্চিমের অতিলৌকিক কাহিনির অনুবাদও চোখে পড়ার মতো জায়গা নিয়েছে। এই অবসরে বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে প্রবেশ করলেন পশ্চিমের এমন কিছু লেখক, যাঁদের সঙ্গে সে অর্থে আম বাঙালি পাঠকের পরিচিতি ছিল না। পরিচিত করালেন সাম্প্রতিক প্রজন্মের কিছু অনুবাদক।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের এই মুহূর্তে পরিচয় জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘বিষবৈদ্য’-এর লেখক হিসেবে। কিন্তু নিজের লেখালেখির সমান্তরালে নিরলস ভাবে করে যাচ্ছেন অনুবাদের কাজও। কর্মসূত্রে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় অঞ্চলে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন দেবজ্যোতি। একদা ‘ঠগী বলয়’ হিসেবে পরিচিত ওই সব অঞ্চলে আজও মৌখিক পরম্পরায় জীবিত ঠগী দস্যুদের কাহিনি। কৌতূহলী হয়েই পড়ে ফেলেছিলেন ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত ফিলিপ মিডোজ টেলরের লেখা ‘কনফেসনস অব আ ঠাগ’। সেই বইটিকেই প্রথম অনুবাদ করেন দেবজ্যোতি ‘ঠগীর আত্মকথা’ নামে। আদৃতও হয় সেই অনুবাদ। এর পরে ‘অজানা ১০’ নামে এক সিরিজে দেবজ্যোতি প্রকাশ করেন আমেরিকান লেখক হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট, আর্থার কোনান ডয়েল প্রমুখের কিছু রচনা। এই সিরিজে তিনি তেমন লেখাকেই রাখতে চেয়েছিলেন, যাদের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচিতি কম। লাভক্র্যাফটের একটি উপন্যাস এর আগে অদ্রীশ বর্ধনের দ্বারা অনূদিত হলেও, সে ভাবে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে এই দিকপাল লেখকের পরিচিতি ছিল না। লাভক্র্যাফট মূলত হরর ঘরানার লেখক হলেও তাঁর কাহিনিগুলি নিছক ‘ভূতের গল্প’ নয়। লাভক্র্যাফটই বিশ্বসাহিত্যে ‘কসমিক হরর’ নামক একটি বিশেষ ধারাকে নিয়ে এসেন। এর পাশাপাশি লাভক্র্যাফট এমন কিছু গল্প লিখে গিয়েছেন, যাকে ‘বিমূর্ত’ শ্রেণিভুক্ত করা ছাড়া উপায় থাকে না। দেবজ্যোতি এই ধরনের কাহিনিকেও অনুবাদ করেছেন। বস্তুতপক্ষে এমন কাজ অনুবাদকের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ, সে কথা নিজেও স্বীকার করলেন অনুবাদক। জানালেন, ইচ্ছা রয়েছে লাভক্র্যাফটের সমগ্র কাহিনিকে বাংলায় অনুবাদ করার। রোমাঞ্চ কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করেছেন আলবার্তো মোরাভিয়ার রচনা। শুধু কাহিনি নয়, নন ফিকশন অনুবাদেও যাথেষ্ট আগ্রহী দেবজ্যোতি।
সমাজমাধ্যমের দৌলতে বাংলা ওয়েবজিন এখন বাঙালি পাঠকের মুঠোবন্দি। ওয়েবজিন আর সমাজমাধ্যম সূত্রেই আর এক নিরলস অনুবাদকের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় হয়েছে। তাঁর নাম ঋজু গঙ্গোপাধ্যায়। অনুবাদক হিসেবে তাঁরও পছন্দের ক্ষেত্র হরর-রোমাঞ্চ-রহস্য কাহিনি। ২০১৬ নাগাদ ঋজু আর্থার কোনান ডয়েলের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত কিছু গল্পকে বাংলায় অনুবাদ করেন। ঋজুর আগ্রহ মূলত জনপ্রিয় বিশ্ব সাহিত্যের সেই সব লেখার অনুবাদেই, যা এই ভূমিতে কম পরিচিত। ২০১৯-এ ঋজুর অনুবাদে প্রকাশিত হয় ‘এবি’ নামের একটি বই। এখানে তিনি ইংরেজ লেখক অ্যালজারনন ব্ল্যাকউড এবং আমেরিকান লেখক অ্যাম্ব্রোজ বিয়ার্সের বেশ কিছু গল্পকে দুই মলাটের মধ্যে নিয়ে আসেন। ব্ল্যাকউড এবং বিয়ার্সের মধ্যে নাম- পদবির আদ্যক্ষরগত মিল ছাড়াও আর যেখানে মিল ছিল তা হল এই যে, দুজনেই হরর কাহিনির দিকপাল লেখক। এই দুই লেখকের প্রভাবই পড়েছিল বাংলা সাহিত্যের ভয়ের কাহিনির লেখকদের উপরে। আগে বিক্ষিপ্ত ভাবে বিয়ার্স ও ব্ল্যাকউড যে অনূদিত হননি, তা নয়। কিন্তু এই প্রথম সংহত ভাবে তাঁদের কিছু প্রতিনিধি-স্থানীয় রচনাকে বাংলায় নিয়ে আসা হল। ঋজুর কথায়, এই দুই লেখক ভয়ের গল্প লিখলেও দু’জনের লিখনের মধ্যে শৈলী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক। দুই আলাদা ভূগোলের মানুষের ইতিহাসগত প্রেক্ষিতও আলাদা। বিয়ার্স আমেরিকার গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছেন। আবার ব্ল্যাকউড ছিলেন প্রাচ্যদেশীয় আধ্যাত্মিক জগতে বিশেষ আগ্রহী। ফলে তাঁদের দু’জনের লেখা সম্পূর্ণ অর্থেই পৃথক চরিত্রের। এই বৈচিত্রকেও দু’মলাটে নিয়ে আসা ছিল তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জ বিশেষ, জানালেন ঋজু। এর পরে ঋজু হাত দেন ইংরেজ লেখক উইলিয়াম হোপ হজসনের অনুবাদে। হজসনও ভয়ের গল্পের আর এক কাণ্ডারি। ‘ভয়, রহস্য, হজসন’ নামে সেই গ্রন্থ সম্প্রতি প্রকাশিতও হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও লাভক্র্যাফট তাঁর ‘গাইড’ হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানালেন অনুবাদক। লাভক্র্যাফটের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সুপারন্যাচারাল হরর ইন লিটারেচার’-এ তিনি যে ক’জন লেখককে প্রণিধানযোগ্য হিসেবে আলোচনা করেছিলেন, হজসন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এক দিক থেকে দেখলে হজসনের রচনাও বাংলায় তেমন একটা অনূদিত হয়নি।
লাভক্র্যাফট ভয়াল রসের আর এক সাহিত্যিকের গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি ইংরেজ লেখক মন্টেগু রোডস জেমস। পেশায় ইতিহাসের গবেষক-অধ্যাপক জেমস ভয়ের সাহিত্যের এক দিশারী। হরর সাহিত্যে তিনি এক বিশেষ ঘরানার জন্মদাতা। বাংলার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিভূতিভূষণ, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের উপরেও জেমসের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। জেমসীয় ঘরানার প্রাথমিক শর্তই হল, কোনও প্রত্নবস্তুকে ঘিরে ঘনীভূত হয় আতঙ্ক। সেই জেমসের পাঁচটি প্রধান রচনাকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন রাজর্ষি গুপ্ত। শুধু অনুবাদ নয়, ‘ছায়া কায়া ভয়’ নামের এই সংকলনে একটি দীর্ঘ ভূমিকা ও কাহিনিগুলির টিকা সংযোজিত করেছেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক রাজর্ষি। তাঁর মতে, অনুবাদ কেবলমাত্র ভাষান্তর নয়, তা একটা সাংস্কৃতিক সেতু। কেন জেমসকে বেছে নিলেন অনুবাদের জন্য? এই প্রশ্নের জবাবে রাজর্ষি জানালেন, জেমসের লেখায় ইতিহাসের অন্ধকারময় দিকটিকে তুলে ধরার প্রবণতা বেশি। এটা তাঁকে আকর্ষণ করেছিল। আর এই কাহিনিগুলির টিকাও প্রয়োজন ছিল। কারণ মহাপণ্ডিত জেমসের প্রায় প্রতিটি গল্পেই ছড়িয়ে রয়েছে বাইবেল বা প্রাচীন কালোজাদুর রেফারেন্স। এই সব বাঙালি পাঠকের কাছে অচেনাও লাগতে পারে, তাই টিকার অবতারণা।
বোঝাই যাচ্ছে, বাংলা জনপ্রিয় অনুবাদ সাহিত্যের ধারাটি এখনও রহস্য-রোমাঞ্চের দিকে ধাবমান। হোমস-পরবর্তী বিদেশি গোয়েন্দা কাহিনি বাংলায় তেমন অনূদিত হয়নি (আগাথা ক্রিস্টি কিছু অনুবাদ হয়েছিল, কিন্তু সেগুলি কতটা কপিরাইট আইন মেনে করা, সন্দেহ আছে)। কপিরাইটের কারণে সমসাময়িক জনপ্রিয় বিদেশি সাহিত্য, এমনকি প্রতিবেশী সাহিত্যও বাংলা অনুবাদে অধরা। আপাতত বাংলা অনুবাদকদের চোখ এমন লেখকদের দিকেই, যাঁরা এই ভূমির মূলধারার পাঠকৃতিতে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত। উদ্দেশ্য সাধু, সন্দেহ নেই। কিন্তু এত বেশি ভৌতিক কাহিনির উপস্থাপন অনুবাদ সাহিত্যকে একপেশে করে ফেলছে না তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy