মোদীপাড়া দুর্জনেষু, সবাইকে গৈরিক অভিনন্দন ভাই। এত দিনে একটা কাজের মতো কাজ করেছেন। যে বাঙালি এখনও বিজেপিকে ভোট দেবে কি না, তা নিয়ে ধন্দে ছিল, তাদের অনেকেই উত্তর পেয়েছে। এর মধ্যেই আপনারা কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে গেরুয়া টি-শার্ট গায়ে সিঁড়ির পোস্টার ছিঁড়ে দিলেন। কফি হাউসে অনেক টি-শার্ট, টপ, কামিজ, ওড়না দেখেছি, ভাই। কিন্তু সেনাদের মতো একই উর্দিতে সবাই মার্চ পাস্ট করে ঢুকছে আগে দেখিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় যত বার দেখছি, শাহরুখ-কাজলের এক সঙ্গে গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘রং দে তু মোহে গেরুয়া’।
ওই আধিপত্যকামী, মারকুটে পুরুষসর্বস্ব দলটিতে অবশ্য কোনও মহিলা ছিলেন না। সেখানেই প্রথম গড়বড়। কফি হাউস থেকে বেরিয়ে কলেজ স্কোয়ারের যে রাস্তায় স্লোগান দিতে দিতে এলেন, সেই রাস্তার মাহাত্ম্য জানেন? আপনাদের মতো পোস্টার-ছেঁড়া বিপ্লব নয়। ট্রাম জ্বলছে, পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে, একটু আগে টিয়ার গ্যাসের শেল ফেটেছে, শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা অনিমেষকে বলে, ‘‘আমার মনে হয় আপনাদের দলও সরকারে এলে একই হবে। টাকার এ পিঠ আর ও পিঠ।’’ শেষে ট্রেনে ওঠার আগে জানায় সে, ‘‘আমার নাম মাধবীলতা মুখার্জি।’’ অনিমেষ জানতে চায়, মাধবী? উত্তর আসে, ‘‘উঁহু, ফুল নয়, আমি শুধুই লতা, মাধবীলতা।’’ সমরেশ মজুমদারের কালবেলা উপন্যাসে এ রকমই আছে। উপন্যাসটা হয়তো আপনারা পড়েননি। পড়লে বুঝতেন, কলেজ স্কোয়ার থেকে মির্জাপুর, হেদো, প্রেসিডেন্সি হয়ে স্কটিশ চার্চ অবধি এলাকাটা বিপজ্জনক। সেখানে নারী-পুরুষ সমান অধিকারে রাজনীতি, সমাজ সব বিষয়ে তর্ক এবং খুনসুটি করতে করতে এগিয়ে যায়। কেউ ‘জয় শ্রীরাম’ আওড়ায় না।
সত্তর দশকের নকশাল অনিমেষকে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ বলবেন তো? তা হলে তারও আগে পঞ্চাশের দশক থেকে সাক্ষ্য দিই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে তরুণ কবি নিরুপম কফি হাউসে বসে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মেয়েদের টেবিল থেকে এক জন উঠে আসে, ‘‘আপনার একটা কবিতা দেবেন?’’ ঘটনার পরে কফি হাউসে মেয়েদের নেতৃত্বেই যে আপনাদের বিরুদ্ধে ‘ক্ষুদিরামের বাংলায় নাথুরামের ঠাঁই নেই’ বলে স্লোগান উঠেছে, তাতে মোটেই আশ্চর্য হবেন না।
এ-সবের মর্ম অবশ্য আপনাদের বোঝার কথা নয়। মেয়েদের সমান অধিকার হিন্দুত্ববাদের ডিএনএ-তে নেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে কফি হাউসের বাঙালি ক্রমশ তার আধুনিকতার টানাপড়েন নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর এক নিবন্ধে চিত্রশিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথার উল্লেখ করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে আত্মজীবনীতে তাঁর বক্তব্য, ‘‘কফি হাউসের আড্ডায় মেয়েরা সবে আসতে শুরু করেছে। এই সময় থেকেই দেখতাম, ছেলেরা কোনও মেয়েকে ঘিরে নিয়মিত আড্ডা দেয়। আমরা নারীবর্জিত আড্ডাধারীরা সেই অল্পবয়সি ছেলেগুলিকে বেশ ঈর্ষা করতাম।’’ দেবব্রতবাবুর কথা মনে আছে আর এক ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রেরও। ষাট-সত্তরের সেই উত্তাল দিনে কমিউনিস্ট ছাত্রদের মারবে বলে তৎকালীন নব কংগ্রেসের ছেলেরা কফি হাউসে ঢুকে এসেছে। দরজার কাছে এক টেবিলে কফির কাপ নিয়ে বসে কাগজে ছবি আঁকছিলেন দেবব্রতবাবু। তিনি ধমকে বলে উঠলেন, ‘‘এখানে কোনও মারপিট হবে না, যাও। যা করার বাইরে।’’ সকলে সুড়সুড় করে বাইরে। দেবব্রতবাবু আর নেই, কিন্তু আপনাদের রুখতে ওই রকম একটি দশাসই বকুনির দরকার ছিল।
জানি, আপনারা কফি হাউসের ভিতরে মারপিট করেননি। কফির স্বাদও নাকি খাসা লেগেছে। শুধু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ পোস্টার দেখে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, তাই সেগুলি ছিঁড়ে ফেল্ট পেনের দাগা বুলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কফি হাউসের ওই সিঁড়ির দেওয়াল তো গ্রাফিতির জন্যই। কোনও প্রজন্মে সেখানে ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’, কোনও প্রজন্মে নন্দীগ্রামের সময় ‘খুনি সিপিএম’, কোনও প্রজন্মে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ থাকতেই পারে। যে দেওয়ালে আজ শম্ভু মিত্রের নাটকের পোস্টার থাকবে, কয়েক বছর পর সেখানেই থাকবে বাদল সরকারের নতুন নাটকের নাম। ‘‘ওই পোস্টার দেখেই একটা প্রজন্মের মতিগতি বোঝা যায়, আজ অবধি কফি হাউসে কেউ পোস্টার ছেঁড়েনি। এটা একেবারেই নতুন ঘটনা,’’ বলছিলেন গৌতমবাবু। শুনতে শুনতে মনে পড়ল, তিন দশক আগে বাংলা ১৩৯৬ সালে শারদীয়া এক্ষণ পত্রিকায় কফি হাউস নিয়ে সুচিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি স্মৃতিকথা বেরিয়েছিল। সুচিৎবাবু কফি হাউসে প্রথম যুগের কর্মী। তখন কফি বোর্ড জায়গায় জায়গায় বিজ্ঞাপন দিত, ‘রিল্যাক্স অ্যান্ড টক’। মানে, আড্ডা মারতে মারতে বা একা বসে যে কোনও ভাবে আয়েশ করে কফি খাওয়া যায়। ১৯৪৬ সালের স্মৃতিচারণ করছেন সুচিৎবাবু, ‘‘দাঙ্গার জন্য কলেজ স্ট্রিট মাঝে মাঝে রণক্ষেত্র হত— পুলিশ, মিলিটারি ছেয়ে থাকত। কফি হাউসে কিন্তু কোনও আঁচ লাগত না।’’ মোদীপাড়া, আপ ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে।
কারা আসতেন এই কফিঘরে? সন্ধ্যাবেলায় শরৎচন্দ্র বসু, দুপুরে এসে ভেজিটেবল চপ ও এক কাপ কফির অর্ডার পেশ করতেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়। স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মাঝে মাঝে আধময়লা ধুতি আর সবেধন নীলমণি একটি মটকার পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে কফি হাউসে এসে চার আনায় এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। তপন রায়চৌধুরীর মতো ছাত্র-ভক্তেরা মাঝে মাঝে স্যান্ডউইচ অর্ডার করলে খুশি হতেন। যুগান্তর দলের বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্বামী বিবেকানন্দ পেট্রিয়ট-প্রোফেট নামে বিবেকানন্দের জীবনী লিখেছিলেন, ১৯২১ সালের কমিনটার্ন-এ ভারতের হাল নিয়ে লেনিনের সামনে মস্কোয় এক সন্দর্ভ পেশ করেছিলেন। আপনাদের নেতা অবশ্য হামলার পরই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কফি হাউসের লোকেরা চিন, রাশিয়া থেকে আমদানি করা ব্যর্থ আদর্শে বিশ্বাসী, তাঁদের প্রভাব নামমাত্র। তাঁকে ধন্যবাদ। বিবেকানন্দের ছোট ভাই নিষ্ফল এক ব্যর্থ আদর্শ আমদানির জেরে কলেজ স্ট্রিটে কফি পান করতে আসতেন, এ-তত্ত্ব হিন্দুত্ববাদী ছাড়া কে-ই বা প্রচার করতে পারে?
হে মোদীপাড়ার তরুণ তুর্কিগণ, জানি, কফি হাউসের উপর আপনাদের এই আঘাত প্রত্যাশিত। বস্তুত অনিবার্য। বিতর্ক ও ভিন্ন মত পোষণের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি করোনার আগে থেকেই বন্ধ। জেএনইউ, যাদবপুর থেকে বিশ্বভারতী, সব জায়গায় স্টিম রোলার চলছে। কফি হাউস-ই বা রক্ষা পাবে কেন? তপন রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘‘যা শিখেছি, তার অনেকটাই কফি হাউসে সহপাঠীদের কাছ থেকে, রাস্তার ওপারে কলেজে গিয়ে ক্লাসে বসার ব্যাপারে থোড়াই কেয়ার করে।’’ কয়েক বছর পরে অমর্ত্য সেনের স্মৃতিও প্রায় এক রকম। প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী, অকালপ্রয়াত সুখময় চক্রবর্তী তাঁকে প্রথম কফি হাউসে নিয়ে যান। অমর্ত্যর স্মৃতি: অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারোর তত্ত্ব নিয়ে কফি হাউসে আলোচনা করতেন তিনি ও সুখময়। অ্যারোর তত্ত্ব বলেছিল, একনায়কতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সামাজিক চয়নের কোনও পদ্ধতিতেই যুক্তির বিচারে সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব। তাঁরা চিন্তা করতেন— এই তত্ত্ব কি তবে বাম ও ডান, দুই ধারার স্বৈরতন্ত্রকেই ইন্ধন দেয়? অমর্ত্য লেখেন, ‘‘সুখময় সেদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের জানলার পাশে বসে ব্যাখ্যা করছিল, ওর মতে অ্যারোর মডেলটির মানে কী দাঁড়াতে পারে। আর ওর অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত মুখে ঠিকরে পড়ছিল শীতের কলকাতার রোদ।’’
কফি হাউসের জানালায় এখনও রোদ ঠিকরে পড়ে। তবে স্বৈরতন্ত্র ইদানীং সরাসরি আছড়ে পড়ছে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে, জয় শ্রীরাম হেঁকে ছিঁড়ে দিচ্ছে পোস্টার। মোদীপাড়ায় এ রকমই হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy