অতিমারির প্রকোপে আমাদের মুখ মুখোশাবৃত। মুখমণ্ডলের কোন অংশ কতটা ঢাকিব ও কী ভাবে ঢাকিব— তাহা লইয়া নানাবিধ তৎপরতা, নানা জনের নানা মত। আত্মরক্ষার বাসনা যত প্রবল হইতেছে, মুখের উপর মুখোশও তত বেশি পরিমাণে উঠিতেছে। একটি মাস্কে বিশ্বাস নাই, অতঃপর দুইটি— অধিকন্তু স্বচ্ছ মুখাবরণী। মুখের সম্মুখে প্রাচীন যোদ্ধাদের ন্যায় আবরণ। এই সবই চক্ষুতে সহিয়া গিয়াছে। ঢাকা মুখ দেখিতে দেখিতে আমরা খোলা মুখ দেখিবার কথা ক্রমে ভুলিয়াই গিয়াছি। ব্যাধি বড় বালাই, ইহা দোষেরও নহে। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আসিতেছে বলিয়া খবর, অতঃপর মাস্কবিহীন বীরত্ব নিজের পক্ষে ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। এই ব্যাধি তো একার নহে, সাবধানতা গ্রহণ না করিলে অপরেরও ছোঁয়াচ লাগিবে। কিন্তু প্রশ্ন হইল, মুখোশ কি কেবল ব্যাধি দূরীকরণের নিরুপায় অস্ত্র? নহে নহে। ভারতীয় রাজনীতি ও বঙ্গরাজনীতি এই অতিমারিকালে আর এক প্রকার মুখোশের রাজনীতি হইয়া উঠিয়াছে। সেই মুখোশের সহিত স্বাস্থ্যরক্ষার মুখোশের নানা পার্থক্য। স্বাস্থ্যরক্ষার মুখোশ চর্মচক্ষে দেখা যায়, কিনিতেও পাওয়া যায়। রাজনৈতিক মুখোশ দেখা যায় না, পাড়ার দোকানে কিনিতেও পাওয়া যায় না, তবে জনগণ বুঝিতে পারেন— মুখোশ নেতাদের মুখে উঠিয়াছে। ঠিক যেমন শিশুটি বুঝিয়াছিল রাজার কাপড় নাই, তেমনই। জনগণ জানেন চর্মচক্ষে আলাদা করিয়া দেখা যাইতেছে না বটে, তবে রাজার মুখোশ রহিয়াছে। বস্তুত, রাজার মুখোশই সর্বস্ব— মুখ বলিয়া যেন কিছু নাই। মুখোশও একটি নহে, বহু। যখন যেটা প্রয়োজন, রাজা ও তাঁহার পারিষদগণ পরিতেছেন। অবশ্য ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ প্রশ্ন তোলা শিশুটির সহিত জনসাধারণের পার্থক্য রহিয়াছে, তাঁহারা মুখোশ ও রাজনৈতিক ছলাকলার দস্তুর বুঝিতে পারিয়াও কেমন যেন নিজেদের ভুলাইয়া রাখিয়াছেন।
ভোটের ঢাকে কাঠি পড়িয়াছে। দলবদলের খেলা জমিয়াছে। কে যে কখন কোন দলে যোগদান করিতেছেন, তাল রাখা কঠিন! অনেক সময় এক দল হইতে আর এক দলে গিয়া পুনরায় পূর্ববর্তী দলে ফিরিবার বাসনা। দল হইতে এই দলান্তরে গমনের উদ্দেশ্য কী? বলিতেছেন, তাঁহারা নাকি জনস্বার্থে নিবেদিত প্রাণ। জনতার সেবা করিবার জন্য, কাজ করিবার জন্যই এই দলত্যাগ। কথাটির মধ্যে সত্যের ভাগ কয় আনা, তাহা বলিয়া দিতে হইবে না। দলবদলের নানা কারণ— আত্মপ্রচার, গুরুত্বলাভের প্রচেষ্টা যেমন রহিয়াছে, তেমনই কোনও কোনও প্রার্থী তাঁহার কৃতকর্মের উপর যাহাতে নজর না পড়ে, তাহার জন্য শক্তিশালী দলের শরণ লইয়া থাকেন। আবার রাজনৈতিক দলগুলিও বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষদের দলভুক্ত করিবার জন্য জাল বিছাইয়া থাকে। একদা বিশিষ্টরা মাঝে মাঝে এই দল হইতে ওই দলে চলিয়া যান। এক বিচিত্র খেলা। মতাদর্শ, স্থিরতার বালাই নাই— কেবল একই মুখের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বর্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ।
জনগণ বুঝিয়া গিয়াছেন, ইহাই দস্তুর। আদর্শের ও ভাবনার স্থিরতা নাই বলিয়া মুখগুলি যখন-তখন নানা বিপরীত গোষ্ঠীর দরবারে ঘুরিতেছে, ফিরিতেছে, হাসিতেছে, খেলিতেছে। জনগণের আর কাহারও প্রতি তেমন ভরসা নাই। জনদরবারে বিষয়টি লইয়া রঙ্গ-কৌতুকের শেষ নাই। সেই কৌতুকের মধ্যে হতাশা নাই, ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ নাই, এক প্রকার মানিয়া লইবার লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। যেন ইহাই তো হইবার, ইহাই হইবে, আমরা কী করিব। আর ইহাই সর্বাপেক্ষা বিষাদের কারণ। সত্যজিতের হীরক রাজার দেশে ছবিতে লোকায়ত গায়ক খেয়াল করাইয়া দিয়াছিলেন, ‘ভালো জনে রইল ভাঙা ঘরে’; খেয়াল করাইয়া দিয়াছিলেন, ‘সোনার ফসল ফলায় যে তার/ দুই বেলা জোটে না আহার’। শুনিয়া হীরক রাজা রাগিয়া আগুন। গায়কের শাস্তি হইল। সে বিগত শতকের কথা। এই শতকে কৌশলী রাজারা রাগ এই ভাবে প্রকাশ করিবার লোক নহেন। তাঁহারা নানা মুখোশে নানা ভাবে কাজ হাসিল করিবেন। কখনও কৃষকদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করিবেন, কখনও কৃষকপক্ষের কোনও প্রতিনিধিকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের কথা বলাইয়া লইবেন। আর জনগণও সব জানিয়া-বুঝিয়া রঙ্গ করিয়া মানিয়া লইবেন। সর্বোপরি এই মুখোশের মধ্যে যদি সত্যই কোনও আদর্শের মুখ থাকে তাহার প্রতিও জনগণ আর বিশ্বাস স্থাপন করিবেন না। দশচক্রে যথার্থ মুখও এক্ষণে মুখোশ বলিয়া মনে হয়। রাজনীতি ও সমাজে এ বড় বিপদের সময়। মুখোশ আসিয়াছে বলিয়া আমরা মুখটি চিনিতে ভুলিয়াছি। ইহাই প্রকৃত অতিমারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy