—ফাইল চিত্র।
মার্কিন রাজনীতিবিশারদ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তাঁহার দি এন্ড অব হিসট্রি গ্রন্থের কল্যাণে চটজলদি খ্যাতিমান হইবার পরেই যে বইটি লিখিয়াছিলেন, তাহার নাম: ট্রাস্ট। মুক্তবাজারের অর্থনীতি এবং উদার গণতন্ত্রের যুগলবন্দি বাজিবার অনিবার্যতা ঘোষণা করিতে না করিতেই তাঁহাকে বলিতে হইয়াছিল: খোলা বাজার এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য চাই সোশ্যাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক মূলধন। তাহার সরল অর্থ: সামাজিক মানুষ যদি পরস্পরকে বিশ্বাস করেন, তবেই সেই বিশ্বাস তাঁহাদের দৈনন্দিন আচরণে প্রতিফলিত হইবে এবং সেই আচরণই গড়িয়া তুলিবে সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও সুস্থ সমাজ। সমাজগঠনে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসের গুরুত্বের কথা আবহমান কাল ধরিয়া বলা হইয়া আসিতেছে। কিন্তু আধুনিক অর্থশাস্ত্রে সেই কাণ্ডজ্ঞান অনেকাংশে হারাইয়া গিয়াছিল, অর্থনীতির ক্রিয়াপ্রক্রিয়াকে অর্থনীতিবিদরা অনেকেই একটি নৈর্ব্যক্তিক এবং কার্যত যান্ত্রিক ব্যাপার হিসাবে দেখিতে অভ্যস্ত হইয়াছিলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটি তত্ত্বচর্চায় তাহার প্রাপ্য মর্যাদা হইতে বঞ্চিত হইয়াছিল। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল এবং আছে। কৌশিক বসু তাঁহাদের অন্যতম। এই প্রবীণ অর্থনীতিবিদ তাঁহার বিভিন্ন লেখায়, বিশেষত প্রায় এক দশক আগে প্রকাশিত বিয়ন্ড দি ইনভিজ়িবল হ্যান্ড গ্রন্থে স্বভাবসিদ্ধ প্রাঞ্জলতার সহিত বিশ্লেষণ করিয়াছিলেন, মুক্ত বাজারের ঠিক ভাবে কাজ করিবার জন্য মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস কতটা আবশ্যক। সমাজে বিশ্বাস না থাকিলে বাজার অর্থনীতি ভাল চলিতে পারে না।
সম্প্রতি একটি মার্কিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কৌশিক বসু বলিয়াছেন, ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতির পিছনে সামাজিক অ-বিশ্বাসের একটি বড় ভূমিকা আছে। তাঁহার যুক্তিপরম্পরার প্রথম অংশ সংক্ষেপে এই রূপ: ভারতীয় অর্থনীতিতে ভাটার টান চলিতেছে, তাহার একটি বড় কারণ যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাব; এবং বিনিয়োগ কম, কারণ বিনিয়োগকারীদের মনে (সমাজ ও অর্থনীতির) বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যথেষ্ট বিশ্বাস নাই। অনিবার্য ভাবে মনে পড়িবে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেন্স-এর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ধারণাটি: বিনিয়োগ বিশ্বাসের ব্যাপার। কার্যকারণসূত্রটি সুস্পষ্ট। আজ বিনিয়োগ করিলে ফল মিলিবে ভবিষ্যতে। ভবিষ্যৎ স্বভাবত অনিশ্চিত। সুতরাং বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের পিছনে অনুমানই প্রধান চালিকাশক্তি। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশ্বাস আছে কি না, অনুমানের উপর তাহার বিপুল প্রভাব পড়িবেই। বিশ্বাসে যদি ঘাটতি থাকে, বিনিয়োগকারী লগ্নি করিতে চাহিবেন না, নিপাট কাণ্ডজ্ঞানই তাহা বলিয়া দেয়। এই কারণেই ভারতে বিনিয়োগে মন্দা চলিতেছে। কিন্তু বিশ্বাসে ঘাটতির কারণ কী?
এখানেই কৌশিক বসুর যুক্তির দ্বিতীয় অংশ। তাঁহার বক্তব্য: বিভেদের রাজনীতি এবং শাসকদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হইয়াছে, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক স্বাধিকার খর্বিত হইয়াছে, তাহার পরিণামেই সামাজিক বিশ্বাসে বড় রকমের ক্ষয় ধরিয়াছে। বিনিয়োগকারীরা তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন বর্গের মানুষ ও প্রতিষ্ঠান, পরিভাষায় বলিলে ‘ইকনমিক এজেন্ট’রা এই সমাজেরই অংশ। তাঁহারা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ লইয়া নিশ্চিন্ত বোধ করিতেছেন না। ফলে বিনিয়োগের পালে বাতাস নাই। স্পষ্টতই এই পরিস্থিতির দায় শাসক গোষ্ঠীর। অর্থশাস্ত্রীরা সচরাচর এত স্পষ্ট ভাবে রাজনীতিকদের, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের, সমালোচনা করেন না। কৌশিক বসু করিয়াছেন। শাসকরা ইহাতে সন্তুষ্ট হইবেন না, সম্ভবত তাঁহাকেও প্রবাসী শত্রুপক্ষ বলিয়া দাগিয়া দিবেন, তদুপরি বলিবেন— মনমোহন সিংহের সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তো মোদী জমানার নিন্দা করিবেনই! লক্ষণীয়, মনমোহন সিংহও কয়েক দিন আগে এক প্রবন্ধে ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গিন অবস্থার স্বরূপ বিশ্লেষণ করিতে গিয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নাগরিকদের এই বিশ্বাসের অভাবকেই বিশেষ ভাবে দায়ী করিয়াছেন। এবং তিনি বলিয়াছেন, এই প্রবন্ধ তিনি লিখিতেছেন দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসাবে, অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে। অবশ্য এখন যাঁহারা দিল্লি চালাইতেছেন, তাঁহাদের নিকট মনমোহন সিংহের একমাত্র পরিচয়, তিনি কংগ্রেসের নেতা। আপ্ত মন জগৎ দেখে। বর্তমান শাসকরা কোনও শুভবুদ্ধিকেই বিশ্বাস করেন বলিয়া মনে হয় না। তাঁহাদের অভিধানে বিশ্বাস শব্দটি আছে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy