ফাইল চিত্র।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল। শ্রমিক ইউনিয়ন আইন সংশোধনের যে প্রস্তাব সংসদে আনল নরেন্দ্র মোদী সরকার, তা একশো বছর পরে দেশকে ফেরাল একই প্রশ্নে। সেই প্রশ্ন শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতির। লোকসভায় ট্রেড ইউনিয়ন (সংশোধনী) বিল, ২০১৯ পেশ করতে গিয়ে শ্রমমন্ত্রী সন্তোষকুমার গঙ্গোয়ার বলেন, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে বিরোধ শিল্পের পরিবেশ নষ্ট করে। ইউনিয়নের স্বীকৃতি সহজ করতে আইনের সংশোধন প্রয়োজন। নথিভুক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যেও কেবল ‘স্বীকৃতিপ্রাপ্ত’ সংগঠনগুলি শ্রমিকস্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে মালিকপক্ষ ও সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসার আহ্বান পাবে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটি খতিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছে, এটি পাশ হলে দেশের ট্রেড ইউনিয়ন এবং কর্মচারী ফেডারেশনকে ‘স্বীকৃতি’ দেওয়ার এক্তিয়ার থাকবে কেবল সরকারের। এর অর্থ পরিষ্কার। ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি দেওয়া হবে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারের সঙ্গে ইউনিয়নের রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। ‘অস্বীকৃত’ ইউনিয়ন ত্রিপাক্ষিক বা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে উপেক্ষিত হবে। সদস্যদের স্বার্থরক্ষায় দরদস্তুর করার ক্ষমতা হারাবে। অস্বীকৃত শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা আন্দোলন করলে ফৌজদারি ধারা আরোপ করে তাদের কয়েদ করা বা ছাঁটাই করাও সহজ।
১৯১৩ সালে এই ভাবেই শ্রমিক আন্দোলনের উপর চাপ তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে বছর ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এমন সংশোধনী তারা আনল, যাতে শ্রমিক আন্দোলন ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হল, শুরু হল শ্রমিকদের উপর ফৌজদারি ধারার প্রয়োগ। টানা প্রতিবাদের ফলে ১৯২৬ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আইন এল। তৈরি হল ‘রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নস’। যদিও সংগঠন নথিভুক্তির সব শর্ত মানা সত্ত্বেও শ্রমিকদের ফৌজদারি ধারায় কয়েদ করতে কখনও দ্বিধা করেনি ইংরেজের পুলিশ। শ্রমিক আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সংগঠনের নথিভুক্তিও সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটিশরা।
স্বাধীনতার পর থেকে শ্রমিক সংগঠনের নথিভুক্তির কয়েকটি পদ্ধতি সরকার ও ট্রেড ইউনিয়নগুলি সহমতের ভিত্তিতে অনুসরণ করে চলেছে। সেই নিয়ম হল, জাতীয় স্তরে ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি পেতে হলে কম পক্ষে আটটি রাজ্যে সংগঠন থাকতে হয়, আট লক্ষ সদস্য থাকতে হয়। রাজ্যে রাজ্যে রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নস-এর দফতরে আয়ব্যয়ের যে বার্ষিক ‘রিটার্ন’ জমা দিতে হয় ট্রেড ইউনিয়নকে, তাতে উল্লিখিত সদস্য সংখ্যা এবং চাঁদার রসিদও জমা দিতে হয়। এটা এক অলিখিত বিধি বা ‘কনভেনশন’-এ পরিণত হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে সংশোধনী এনেছে, তাতে (২৯-২ক-১,২ ধারায়) বলা হচ্ছে, নথিভুক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যেও কোনগুলি ‘স্বীকৃতি’ পাবে, তা কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার ঠিক করবে। স্বীকৃতির শর্ত কী, কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বীকৃতি দিল বা বাতিল করল সরকার, তার কোনও হদিসই প্রস্তাবিত সংশোধনীতে নেই। এ বিষয়ে বিরোধ ঘটলে সরকারই মীমাংসা করবে। সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আদালতেও যাওয়া যাবে না।
কেন এমন অগণতান্ত্রিক, অস্বচ্ছ আইন আনতে চাইছে সরকার? তার কারণ, সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার রীতি মেনে চলতে চান না নরেন্দ্র মোদী। প্রচলিত রীতি হল, মালিক পক্ষ, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং সরকারের প্রতিনিধি, এই তিন পক্ষের বাৎসরিক বৈঠক হয়। এই ‘ভারতীয় শ্রম সম্মেলন’ ভারতে শ্রমনীতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহরু বরাবর স্বয়ং এর উদ্বোধন করেছেন। কেবল ইন্দিরা গাঁধীর আমলে জরুরি অবস্থার বছরগুলি বাদে এই সম্মেলন প্রতি বছরই হয়ে আসছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর সম্মেলন আর হয়নি। তার কারণ, সর্বভারতীয় বারোটি ট্রেড ইউনিয়নের দশটির সঙ্গে মোদী সরকারের বিরোধ।
বিরোধের উৎস কী? ২০১২ থেকে পর পর চার বছর শ্রম সম্মেলনে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে কিছু সুপারিশ করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল ন্যূনতম বেতন মাসে আঠারো হাজার টাকা ধার্য করা, ন্যূনতম ছয় হাজার টাকা পেনশন, সমস্ত সরকারি প্রকল্পে নিযুক্ত কর্মীদের ন্যূনতম বেতন, প্রতিটি নাগরিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, শ্রমিক কল্যাণের আইনের সার্থক প্রয়োগ, শ্রমিকের আইনি অধিকার দুর্বল না করা, ইত্যাদি। বার বার উপেক্ষিত হয় সব ক’টি দাবি। সরকার আলোচনাতেও বসেনি।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রম সম্মেলনের দিন ঘোষণা করে শ্রম মন্ত্রক। দশটি ট্রেড ইউনিয়ন একযোগে জানায়, প্রধানমন্ত্রী মোদী কেবল নিজের বক্তব্য বলে চলে যাবেন, তা হবে না, শ্রমিক সংগঠনগুলির বক্তব্যও তাঁকে শুনতে হবে। এর পরেই শ্রম মন্ত্রক ওই বৈঠক বাতিল করে। শ্রমিকদের সঙ্গে সরকারের আদানপ্রদান দীর্ঘ দিন স্থগিত আছে।
ফলে বিপাকে পড়েছে সরকার। এক দিকে শ্রমনীতি নিয়ে দেশের মধ্যে অচলাবস্থা। অন্য দিকে বিশ্বের কাছে মুখরক্ষার দায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের (আইএলও) সদস্য ভারত। তার যে কোনও সিদ্ধান্ত ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে আলোচনা করে রিপোর্ট দেওয়ার কথা কেন্দ্রের। তা-ও স্থগিত।
সঙ্কট কাটাতে সরকার এমন শ্রমিক প্রতিনিধি চাইছে, যাঁরা ‘সহমত’ হবেন সহজেই। শ্রমিকের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে কারা আসবেন, সরকার তা নির্ধারণ করতে চায়। অস্বীকৃতির অস্ত্রে ভিন্ন মত, ভিন্ন দাবিকে নস্যাৎ করতে চায় সরকার। এতে শ্রমিকের স্বার্থের সুরক্ষার চিন্তা নেই, আছে কেবল সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ।
ট্রেড ইউনিয়ন সংশোধনী (২০১৯) বিল এখনই সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো দরকার। আশা করা যায়, সেখানেই তা খারিজ হবে।
শ্রমিক সংগঠন ইউটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy