কখনও কখনও এক জন ব্যক্তির উপলব্ধিতেও একটা গোটা সমাজের ছবিটা বেশ স্পষ্ট উঠে আসে। সম্প্রতি অশীতিপর এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বললেন, সেটাই হুবহু তুলে দিলাম। ওই শিক্ষক নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভয়ে নয়, অভ্যাসে।
— তুমি-ই বলছি, আপত্তি নেই তো? থাকলেও কি তুমি বলতে? অনেক ব্যাপার আছে, যেখানে আপত্তি থাকলেও জানাতে নেই। এটা সামাজিক অভ্যাসের ব্যাপার। ধরো তুমি আমার থেকে বয়সে অন্তত পনরো বছরের ছোট, আমাদের সমাজে বয়সের একটা দাম দেওয়া হয়। আবার, আমি সারাজীবন মাস্টারি করে এসেছি, সুতরাং দু’দিক দিয়েই আমি ধরে নিচ্ছি তোমাকে তুমি বলা যায়, আর তুমিও সৌজন্যবশে মেনে নিচ্ছ। কিন্তু, এই যদি আমাকে আমার নাতির বয়সি কোনও সরকারি বাবুর সামনে দাঁড়াতে হত, তখন আর তুমি বলা যেত, আপনি, আজ্ঞে, স্যর করতে হত।
না না, হাসির কথা না, তুমি যে প্রশ্নটা করেছ, তার উত্তর জানতে হলে, কথাটা মাথায় রাখতে হবে। সেটা কেমন? তুমি জানতে চাইছ, গ্রামের রাজনীতি কোন পথে চলেছে? এর জন্য গ্রামের খুঁটিনাটি ব্যাপারস্যাপারগুলো না জানলে চলে না, আর তার মধ্যে সব চেয়ে বড় জিনিস হল ক্ষমতা। এই যেমন বয়স একটা ক্ষমতা, কিন্তু সেটা একেবারে বুনিয়াদি স্তরের— গ্রামসমাজের রোজদিনের যে সম্পর্ক তার মধ্যেই তা কাজ করে, বৃত্তটা যত বাড়ে ক্ষমতার রূপ তত বদলাতে থাকে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গেও বিভিন্ন ক্ষমতার গুরুত্বের পরিবর্তন ঘটে।
এই যে তুমি রাজনীতির কথা জিজ্ঞাসা করছ, এটাই এখন সবচেয়ে জোরদার ক্ষমতা। পঞ্চাশ বছর আগে অন্য রকম ছিল। তখন ক্ষমতা ছিল জাতের। ব্রাহ্মণরা যা ঠিক করে দিত তা-ই হত। আর এখন পার্টির নেতা যা ঠিক করে দেবে তা-ই হবে। পার্টিটাই এখন জাত। একটু ভুল বললাম, জাত আর পার্টি মিলেমেশে একাকার। অন্তরঙ্গে খুব বদল ঘটেনি, কিন্তু বহিরঙ্গটা একেবারে আলাদা। আধারের বর্ণে পদার্থের রং বদলেছে। হেঁয়ালি শোনাচ্ছে? কী করব বলো, সারা জীবন স্কুলে বাংলা পড়িয়ে এসেছি, শয়নে জাগরণে মঙ্গলকাব্য। স্থানীয় নেতারা আমাকে পাগল ভাবে, তাই ঘাঁটায় না, না হলে কবে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিত, কিংবা গাঁ-ছাড়া করত, কেননা সেটাই এখন প্রধান রাজনৈতিক কাজ।
আগে, ধরো পঞ্চাশ বছর পূর্বে, কী হত, গাঁয়ের পাঁচমাথা যেটা বলে দিল সেটাই শেষ কথা। সাধারণ গ্রামবাসীর কিছু বলবার তো দূর, ভাববারও হক ছিল না। ’৬৭-র পর থেকে অবস্থা বদলাতে শুরু করল, লোকে যে নিজেরাও কথা বলতে পারে সেটা লোকেরা নিজেরা বিশ্বাস করতে শুরু করল। ’৭৭-এ পূর্ণব্রহ্ম। আমি কোনও দিন কোনও পার্টি করিনি, কিন্তু ঝোঁকটা ছিল কংগ্রেসের দিকে। বামপন্থীদের বলতাম, বাংলার মাটিতে কাশ্মীরি আপেল ফলে না, রাশিয়া-চিনের বিপ্লব ভারতে হবে না।
বামপন্থী বইপত্রগুলো অবশ্য পড়তাম, ভাল লাগত, বিশেষত, প্রত্যেকে সাধ্য মতো খাটবে, আর প্রয়োজন মতো গ্রহণ করবে, এই নীতিটা আমার খুব পছন্দ হল। কিন্তু, তাও মনে হত, ভারতে ওটা হবে না। গাঁধীর পথটাই পথ মনে হত। কিন্তু, এক দিকে কংগ্রেসে সমূহ পচন, হিংসাকেই রাজনীতির হাতিয়ার করে নেওয়া, ইত্যাদি দেখে এবং অন্য দিকে ’৭৭-এর পর রাজ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক দারুণ জাগরণ প্রত্যক্ষ করে বামপন্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল। সেটা বেশি দিন থাকল না, কারণ তাঁদের কাজে বামপন্থী আদর্শের চেয়ে বেশি ধরা পড়ল গীতার বাণী। দুটো মারাত্মক ক্ষতি তাঁরা করে গেলেন। গীতায় বলা আছে বিদ্বান ব্রাহ্মণ, গাভী, কুকুর, ও চণ্ডালকে সমদৃষ্টিতে দেখা। মারাত্মক ব্যাপার, মানুষের গুণের, মানবিক গুণের সমাদর রইল না। দ্বিতীয়টা হল, সাধু ও পাপী উভয়কেই সমান চোখে দেখা! ফল হল এই, মুড়িমিছরি এক দর, অজ্ঞান ও জ্ঞানবান একাসনে বসে পড়ল। কর্তব্য ছিল অজ্ঞানকে জ্ঞানলাভের যোগ্য করে তোলা, কিন্তু গোড়াতেই যদি যোগ্যাযোগ্যের ফারাকটা মুছে দেওয়া হয় তা হলে যে যোগ্যতার জোরে সমাজে সবাই যোগ্য হয়ে উঠতে পারত সেটা মা কালীর চরণে অর্পিত হয়। তা-ই হল। আর যে পাপীরা এত কাল ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল, তারাই আবার রাজা। আধারের বর্ণে পদার্থের রং বদলানোর ব্যাপারটা এ বার খোলসা হল?
এই বার তোমার প্রশ্ন, রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে? আগে বলে দিয়েছি, পার্টি করিনি, আমি তো বাপু মঙ্গলকাব্যের লোক, তাই ‘পোদ্দার হইল যম’ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বুঝি, অর্থলোভ যে ঘোর অনর্থের মূলে, সেটা বিশ্বাস করি, আর তাই মনে হয়েছিল, বামপন্থী আদর্শটাই পথ— যে যতটা পারবে ততটা শ্রম করবে, যার যতটুকু দরকার তা-ই পাবে, এ রকম একটা অবস্থা হলে লোভের গল্পটাই আসে না— লোক যদি যা দরকার তা-ই পেয়ে যায়, তা হলে তার দরকারটাই তো ফুরিয়ে যায়। কিন্তু সে দিকে না গিয়ে যে রাস্তাটা বামপন্থীরা নিল, তাতে লোভের চাষবাসই বাড়ল। চিরাচরিত দুর্বলরা গোড়ার দিকে যে কিছুটা ক্ষমতা পেয়েছিল, তা পুরনো পাপীদের হাতে চলে গেল। তাদের তো, আরও আরও দাও। লোভ থেকে দৌরাত্ম্য। মানুষের উপর মানুষের জোর ফলানো। লোকে হতাশ হল।
মিথ্যা বলব না, এখন যে তৃণমূল দল ক্ষমতায়, আমি কোনও দিন মনে করিনি দলটার কোনও আদর্শ আছে, এখানেও সেই গীতার বাণী— আমিই সব, আমাতে আস্থা রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। তা যদি হত তা হলে আর রাজনৈতিক দলের দরকার কিসে? তবু, আমি এই দলটাকেই ভোট দিলাম। আমার মতো বহু লোক দিল। কেন? না, একটু খোলা বাতাসে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিতে। পার্টি সব, বিয়েশাদি, শ্রাদ্ধশান্তিতেও পার্টির হুকুম— এ জিনিস আর সহ্য হচ্ছিল না। এল বহুপ্রতীক্ষিত পরিবর্তন। পাত্র বদল হল, বস্তু প্রায় একই রইল। পচনের প্রক্রিয়া দ্রুততর হল, এক দিকে ‘সো(অ)হম্’-এর বিকেন্দ্রীভবন, অন্য দিকে গুণের ক্ষয়, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, বচনে, অঙ্গভঙ্গিতে ক্ষমতার অশ্লীল প্রকাশ। সরকার যে ভাল কাজ কিছুই করছে না তা নয়, কিন্তু গোটা পৃথিবী জুড়ে যদি দেখো, মানুষ নিজে কিছু হতে চায়। অত বিরাট যে সোভিয়েট দেশ, সেখানে যত ভাল কাজ হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার দ্বিতীয় নিদর্শন বোধহয় নেই। কিন্তু, সেটাও তো টিকল না। কেন? না, ভাবের ঘরে চুরি— মানুষের যে একটা মন থাকতে পারে, সেটা মানা হল না।
এখানেও মানুষের মন নিয়ে ছিনিমিনি চলছে। এখন তাই অনেকেই আরও একটা বদল চাইছে। “ওদের দেখলাম, এদেরও দেখলাম, এ বার তাদেরও এক বার দেখি” এই রকম একটা ভাব দেখতে পাচ্ছি। সমস্যাটা কোথায় জানো, বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার চর্চা কমেছে, অবকাশও। না হলে, যে অত্যাচার থেকে মানুষ নিষ্কৃতি পেতে চাইছে, তার বহুগুণ বেশি অত্যাচার যে ঘনিয়ে আসছে সেটা লোকে দেখতে চাইছে না কেন? যে দলটা এখন রাজ্যে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে, নাম করেই বলছি, বিজেপি, তার আদর্শ কী? ধর্মের কথা বলে, কিন্তু ধর্মের ধ জানে না। বেদ-উপনিষদ তো দূর, রামায়ণ-মহাভারতও পড়েছে বলে মনে হয় না। তমোগুণ ছাড়া অন্য কোনও গুণের কথা এদের অজানা। সেটাই এদের আকর্ষণী শক্তি— যাবৎ কুকর্মপারংগম তথাকথিত নেতারা হুড়হুড় করে বিজেপির খাতায় নাম লেখাচ্ছে। দলটা কেমন, তা বুঝতে আর কিছু কি দেখার দরকার আছে?
তবু যে লোকে এই দলটার দিকে কিছুটা হলেও ঝুঁকছে, সেটা দলের টানে বলে আমি বিশ্বাস করি না, ওটা আসলে অপশাসনের ঠেলায়। চুরি, দুর্নীতি এখন রাজনীতির শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো, তার উপর সদাসর্বদা হুকুমবাজি। লোকে মানবে কেন? চাইছে পরিবর্তন। সে চাওয়াটাকে সদর্থক পথে নিয়ে আসার রাজনীতি নেই, বামপন্থীরা বিশ্বাসযোগ্যতা দু’ভাবে হারিয়েছেন। এক, মানুষের স্মৃতি ক্ষীণ হলেও বাম শাসনের দিনগুলো মুছে যায়নি। আর দুই, সাহসের সঙ্গে নীতিমান রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা তাঁরা সাত বছরে দিতে পারেননি। তাঁদের দলটা দল, একা কেউ চালায় না, দলে ভাল লোকেরও অভাব নেই, কিন্তু আত্মবিশ্বাস নেই। কোথা থেকে আসবে? তাঁরা তো নতুন মানুষ গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি।
তবু বলব, বাংলাকে আরও কলুষে নিমগ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব, যদি নাকি তার সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে লেগে থাকা ময়লাগুলো সাফ করার কাজটা এখনই শুরু করা যায়। সবাই মিলে, পার্টি-অপার্টি নির্বিশেষে। রাজনীতি তো অঙ্গার নয় যে, ধুলে পরিষ্কার হবে না। আর রাজনীতি শুধু পার্টির লোকের ক্যাশবাক্স নয়, এটা সবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy