বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিচ্ছেন আশাকর্মীরা। নিজস্ব চিত্র
পথঘাট সুনসান। মাথার উপরে গনগনে রোদ। করোনা আতঙ্কে ঘরবন্দি মানুষজন। আর ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন দুই স্বাস্থ্যকর্মী। গ্রামের মানুষজন যাঁদের ‘আশাদিদি’ বলেই চেনেন। সঙ্গী, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের আরও এক দিদিমণি। করোনা-ভীতি উপেক্ষা করেই গ্রামীণ স্বাস্থ্য-পরিষেবার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন আশাকর্মীরা।
সাতসকালেই বেরিয়ে পড়ছেন তাঁরা। গ্রামের এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, এক টোলা থেকে আর এক টোলা চষে তুলে আনছেন নানা তথ্য। নতুন কে ঘরে ফিরল, ফিরলে কোথা থেকে ফিরেছে, কবে ফিরেছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিল কি না, হাসপাতালের ডাক্তারবাবু কোনও কাগজ দিয়েছেন কি না, এমন হাজারো প্রশ্নের জবাব যে চাই। প্রয়োজনে ‘হোম কোয়রান্টিন’ কী বস্তু, বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বোঝাতে হচ্ছে তা-ও। এখানেই শেষ নয়। যাঁরা ফিরেছেন, তাঁদের কারও জ্বর এসেছে কি না, অথবা বাড়ির কেউ জ্বরে ভুগছেন কি না, জ্বর না থাকলে অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা বা উপসর্গ রয়েছে কি না, খুঁটিনাটি জানতে হচ্ছে সবই।
প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতেই একেবারে নিচুতলায় স্বাস্থ্য-পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি। এক-একটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র সামলানোর দায়িত্ব থাকে দু’জন ‘এএনএম’ (প্রথম ও দ্বিতীয়) পদমর্যাদার কর্মীদের উপরে। গর্ভবতী ও প্রসূতিদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও শিশুদের বিভিন্ন টিকাকরণের কাজ দেখভাল করেন তাঁরা। পাশাপাশি, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ফাইলেরিয়া আক্রান্তদের খুঁজে বার করা, তাঁদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়ার মতো নানা বিষয়ও এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির উপরে বর্তায়। আর এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির মূল চালিকাশক্তি হলেন আশাকর্মীরাই।
এক-একটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে বেশ কয়েকজন করে আশাকর্মী থাকেন। কমবেশি তেরোশো-চোদ্দোশো জনসংখ্যার এলাকা ধরে চলে তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম। এলাকার বিভিন্ন পাড়ার বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গর্ভবতীদের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিদিমণিদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে প্রসবকালে গর্ভবতীদের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে সহায়তা করা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে প্রয়োজনে নিশ্চয়যানের ব্যবস্থা করা, প্রসবকালে সঙ্গ দেওয়া থেকে নবজাতকের টিকাকরণের কর্মসূচি অবগত করার মতো কাজগুলি আশাকর্মীদের রুটিনেই পড়ে।
তবে করোনা পরিস্থিতিতে ছবিটা বদলেছে। আশাদিদি বা কোথাও ‘এএনএম’ দিদিমণিদের যাতায়াত যেহেতু বাড়ির একেবারে অন্দরমহলে, তাই করোনা মোকাবিলায় বাড়তি দায়িত্বের বোঝা চেপেছে তাঁদের উপরেই। ‘লকডাউন’ পর্বে ভিন্ রাজ্যের কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। বাড়িতে বা গ্রামে ফিরলেই তাঁদের ১৪ দিন ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই পর্বে তাঁদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যায় পাশে থাকছেন এই আশাকর্মীরাই। শুধু তাই নয়। রাঢ়বঙ্গের বেশির ভাগ গ্রামেই মানুষজনের ঘরের সংখ্যা কম। বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় একটি বা দু’টি ঘরেই কার্যত গাদাগাদি করে পরিবারের সকলকে থাকতে হয়। এই পরিস্থিতিতে স্বল্প পরিসরে কী ভাবে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তার পরামর্শও দিচ্ছেন আশাকর্মীরা। পরে তাঁদের মাধ্যমেই করোনা-সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ‘এএনএম’ দিদিমণিদের কাছে। জেলার প্রতিটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পরে তা পৌঁছচ্ছে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আর সেখান থেকে জেলায়। এই ভাবে করোনা মোকাবিলায় একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে লড়াই করছেন আশাকর্মীরাই।
এ তো গেল যাঁরা বিধিবদ্ধ ভাবে ঘরে ফিরছেন, সেই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। এ ছাড়া, অনেকেই আছেন, যাঁরা নিজস্ব উদ্যোগে বাড়ি ফিরেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি হয়ত এমন কোনও রাজ্যে কর্মরত ছিলেন, যে রাজ্যে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে বাড়ি ফিরলেও তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কোনও রকম শারীরিক পরীক্ষাই করাননি। অনেকে ফিরছেন চুপিসারে। স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে এই সব ব্যক্তিদের শারীরিক পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো, পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করার মতো ঝামেলার কাজও জুড়েছে এই পরিস্থিতিতে। এখানেই শেষ নয়। কোয়রান্টিনে থাকা লোকজন নিভৃতবাসের পরামর্শ মানতে না চাইলে বা ১৪ দিনের কোয়রান্টিন চলাকালীন পাড়ার চায়ের দোকান বা গ্রামের হরিমন্দিরে আড্ডার খবর পেলে ‘এএনএম’ দিদিমণিদের মাধ্যমে এলাকার সিভিক ভলান্টিয়ার বা পুলিশের কাছে খবর পাঠানোর কাজও করতে হচ্ছে আশাদিদিদেরই।
‘লকডাউন’ ঘোষণার পরে দু’মাসের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। দীর্ঘসময় পুরুলিয়া জেলা গ্রিন জ়োনে থাকলেও এখন একটি-দু’টি করে সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসতে শুরু করেছে। দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা আসতে শুরু করেছেন। স্বভাবতই এতে চাপ বাড়ছে নিচুতলায় কর্মরত এই সব স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে। পাশের জেলা বাঁকুড়াতেও একাধিক সংক্রমণের খবর মিলেছে। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি চার দফা দাবি নিয়ে রাজ্য জুড়ে দাবি দিবসও পালন করেছেন আশাকর্মীরা। দাবি উঠেছে, গ্রামে গ্রামে যাঁরা ফিরছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানিক কোয়রান্টিনে রাখা বাধ্যতামূলক করা হোক।
করোনা-পরিস্থিতিতে কাজ ঢুকে পড়ছে আশাকর্মীদের বাড়ির অন্দরেও। তাই ফি দিনের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সংসার, সন্তানকে সামলানোর ফাঁকেও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিদিমণিদের কাছে ফোনের মাধ্যমে এলাকার খুঁটিনাটি পৌঁছে দিতে সদা ব্যস্ত আশাদিদিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy