Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

‘বিদ্যালয়ের ভিতপত্তন হল এই লাইব্রেরি দিয়ে’

ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পাশাপাশি লাইব্রেরি বিষয়টি প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এক নতুন পথের দিশা পায়। এখন থেকে শতাধিক বছর আগে পরাধীন ভারতের মানুষের মনে, লাইব্রেরি নিয়ে সেরকম ধারণা ছিল না। তখন রবীন্দ্রনাথই শিক্ষায় লাইব্রেরির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। লিখছেন সুকুমার দাস।ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পাশাপাশি লাইব্রেরি বিষয়টি প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এক নতুন পথের দিশা পায়। এখন থেকে শতাধিক বছর আগে পরাধীন ভারতের মানুষের মনে, লাইব্রেরি নিয়ে সেরকম ধারণা ছিল না। তখন রবীন্দ্রনাথই শিক্ষায় লাইব্রেরির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০১:১৬
Share: Save:

শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজ বিশ্ব-স্বীকৃত। শিক্ষার স্থান হিসেবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নিয়েও তাঁকে নানা সময়, নানা চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে। ব্রহ্মবিদ্যালয় থেকে বিশ্বভারতী, সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের যাত্রাপথে নানা পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন তাঁকে স্বীকার করে এগোতে হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে লাইব্রেরি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ফলে লাইব্রেরি নিয়েও তাঁকে নানা ব্যবস্থাপনা কিংবা নিয়ম-নীতি প্রণয়নে নতুন নতুন ভাবনা নিতে হয়েছে। পাঠ্যসূচি থেকে সংস্কৃতিচর্চা, বিদ্যার্জন থেকে জ্ঞানগর্ভ গবেষণা— সব ক্ষেত্রেই লাইব্রেরির অপরিমেয় ভূমিকা রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, এক কথায় তা বিরল।

একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে আপাদমস্তক স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে অন্য কিছুর সঙ্গে লাইব্রেরি নিয়ে তিনি কী পরিমাণ ভাবিত ছিলেন, তা তাঁর কাব্য-সাহিত্য, নির্দেশিকা, ভাষণ-অভিভাষণ কিংবা আত্মীয়-অনাত্মীয়দেরকে লেখা অজস্র চিঠিপত্রে প্রকাশ ঘটেছে। এর কোনও নিবিড় পাঠ আমরা সে ভাবে দেখি না। এমনকি এ নিয়ে কোনও দীর্ঘ আলোচনা প্রায় অনালোকিত মনে হয়। রবীন্দ্র-রচিত ‘লাইব্রেরি’ ও ‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য’ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে প্রভূত মূল্যবান সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্বভারতীর প্রেক্ষাপটে তিনি কী ভাবে সেগুলির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন, তা নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ আছে।

রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাগার-মনস্কতার এমন কিছু সংবেদনশীল দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা প্রায় অনালোচিত। যেমন তিনি বলেছিলেন, “গ্রন্থাগার আমার নিকট অতি মূল্যবান বস্তু, সমাজের একটি অপরিহার্য অবয়ব। গ্রন্থালয় ভবনে সঞ্চিত থাকে অমূল্য সম্পদ— পুরাবৃত্তের কাহিনী, প্রাচীন ঋষি ও সুবিজ্ঞ মনীষীদের চিন্তাধারা যাহা শাশ্বতকাল ধরিয়া আমাদের প্রাণে বল ও জ্ঞান সঞ্চার করিবে। ... এইজন্য আমার নিকট ইহা পবিত্র ভূমি।” তাঁর লেখায় লাইব্রেরির বিভিন্ন দিক নিয়ে এত সুদূরপ্রসারী ও সূক্ষ্ম অনুভূতিপূর্ণ আবেদন রয়েছে— যা আজও বিশ্বের চিন্তাশীল মনীষী জগতে দুর্লভ!

১৯০১ সাল থেকে ব্রহ্মবিদ্যালয় পর্বে, কর্মকাণ্ডের দিক থেকে লাইব্রেরি কী ভাবে তাঁর আশীর্বাদধন্য হয়েছিল, তা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ১৮৮৮-তে যে ট্রাস্টডিড গঠন করেছিলেন, সেখানে ‘ব্রহ্মবিদ্যালয় ও পুস্তকালয় সংস্থাপন’-এর একটি ঐতিহাসিক দলিল রচিত হয়েছিল। বিশেষত লাইব্রেরির ক্ষেত্রে।

সেখানে দেখা যায় ‘শান্তিনিকেতন গৃহে’র ‘আদি দ্বিতল বাড়িটি’ ছিল বিশ্বভারতী-লাইব্রেরির আঁতুড়ঘর। কলকাতা থেকে আনানো মহর্ষির ‘নিজের ব্যবহৃত সংস্কৃত, ইংরাজি, বাঙ্গালা বহু সংখ্যক পুস্তক ও পুস্তকাধার’ নিয়ে গঠিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের প্রথম লাইব্রেরি। পরে ‘কলকাতার আদি ব্রাহ্মসমাজ’ উঠে গেলে সেখানকার বই ও পত্র-পত্রিকা, এই লাইব্রেরির সংগ্রহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এই লাইব্রেরি প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার বলেছেন, “আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর এখানে একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থাগারের পত্তন করা হয়। ... ঐ সকল গ্রন্থে ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম বোলপুর’ লেখা গোল ছাপ দেওয়া।”

পরবর্তী ধাপে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সূচনাপর্বে, লাইব্রেরির ক্ষেত্রেও কবির প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ করার মতো বিষয় ছিল। ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধে তাঁর প্রথম শান্তিনিকেতন আগমনের কথা বলেছেন।

সেখানেই রয়েছে আশ্রম-লাইব্রেরির আদি পর্বের কথা— “... একটা সৃষ্টির সংকল্প নিয়ে সেখান থেকে (শিলাইদহ) এলেম শান্তিনিকেতনের প্রান্তরে। ... একটি মাত্র পাকা বাড়ি ছিল একতলা, তারই মধ্যে ছিল পুরানো আমলের বাঁধানো তত্ত্ববোধিনী এবং আরও কিছু বাইয়ের সংগ্রহ। এই বাড়িটিকেই পরে প্রশস্ত করে এবং এর উপরে আরও একতলা চরিয়ে বর্তমান গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে।” অল্পকালের মধ্যে বলেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ব্রহ্মবিদ্যালয়-গৃহ-নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে সেখানেই গ্রন্থাগার স্থান পায়। ফলে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পাশাপাশি লাইব্রেরি বিষয়টি প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এক নতুন পথের দিশা পায়। এখন থেকে শতাধিক বছর আগে পরাধীন ভারতের মানুষের মনে, লাইব্রেরি নিয়ে সেরকম ধারণা ছিল না। তখন রবীন্দ্রনাথই শিক্ষার প্রয়োজনে লাইব্রেরির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। এই প্রয়োজন এবং উপলব্ধি আবার শহর-নগর ছাড়িয়ে বীরভূমের এক রুক্ষ মরুভূমিতে প্রয়োগ করেছিলেন। কাজেই সব দিক থেকে শান্তিনিকেতন-লাইব্রেরি যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস বহন করে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বাল্যাবস্থা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বইপত্রাদি ছিল কবির নিত্য সহচর। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের সফরসূচিতেও দেখা যায়, প্রায় সময় একটি ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাঁর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় কিংবা বিশ্বভারতীর জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষার হাজার হাজার বই উপহার হিসেবে পেয়েছেন। আশ্রমের পড়ুয়া বা মাস্টারমশাইদের জন্য বই কিনে পাঠিয়েছেন, লাইব্রেরির কথা ভেবে বই সংগ্রহও করেছেন। বিশ্বভারতী গঠন পর্বে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গিয়ে অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে, যেখানে অর্থ সাহায্য পাওয়া দুর্লভ মনে হয়েছে, তার পরিবর্তে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের জন্য, লাইব্রেরিকে উৎকৃষ্ট করে তোলার জন্য, রাজা-মহারাজা কিংবা গুণী-পণ্ডিতদের কাছে গ্রন্থভিক্ষা চেয়েছেন! শুধু প্রতিষ্ঠানগত ভাবে নয়, এক জন সচেতন সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকায় লাইব্রেরি নিয়ে তাঁর এই উদ্যোগ প্রায় সব দিক থেকেই অভূতপূর্ব। তিনিই সমাজকে প্রথম বুঝিয়েছিলেন, লাইব্রেরি কেবল চিত্তবিনোদনের স্থান নয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক নীরব সাধনক্ষেত্র। কবি সাহিত্যিক দার্শনিক সুরকার গীতিকার শিল্পী রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত বিশ্বে একজনই, যিনি গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগার নিয়ে এত অনুভূতিপূর্ণ চিন্তা করেছেন।

এক শতক আগের বিশ্বভারতী-লাইব্রেরির ইতিহাস বলতে গেলে, অন্য অনেকের মতো কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের উপরে বেশি নির্ভর করতে হয়। রথীন্দ্রনাথ যখন আশ্রম-বিদ্যালয়ের ছাত্র, পরিণত বয়সে স্কুল-জীবনের স্মৃতি তুলে ধরেছেন তাঁর নানা রচনায়। তাঁর নিপুণ বর্ণনায় তখনকার লাইব্রেরি, বইপত্রাদি নিয়েও নানা মূল্যবান কথা উঠে এসেছে। বলেছেন, “... অতিথিশালাকে বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষে বাধা ছিল তাই আশ্রমের তিনকামরাওয়ালা বাড়িটিকে (পরে তৈরি হয়েছিল) আমাদের স্কুলে পরিণত করা হল। আমবাগানের দক্ষিণ পশ্চিমকোণে এই বাড়িটি এখানকার গ্রন্থাগারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে ...। তিনটি ঘরের একটিতে রক্ষিত হল পিতৃদেবের (রবীন্দ্রনাথের) পুস্তক সংগ্রহ। আগে ব্যবস্থা হল পুঁথিপুস্তকের, অতঃপর ভাবনা হল ছাত্রদের আবাসগৃহ কোথায় করা যায়।” এখান থেকে এই বিষয়গুলি স্পষ্ট হয় যে, গ্রন্থাগারের স্থান পরিবর্তন অর্থাৎ শান্তিনিকেতন গৃহ থেকে আশ্রম-বিদ্যালয়— লাইব্রেরির এই প্রাথমিক পর্যায়ে কবির নিজের ব্যবহৃত গ্রন্থাদি স্থান পেয়েছিল ইত্যাদি। অন্য দিকে, ছাত্রাবাসের কথা ভাবার আগে বইপত্র সযত্নে রাখার কথা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।

রথীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, “বাবা তাঁর নিজের যত বইয়ের সংগ্রহ ছিল, কলকাতা থেকে সব আনিয়ে নিলেন এবং তাই দিয়ে ঐ বাড়ির (ইস্কুল) মাঝের বড়ো ঘরটায় লাইব্রেরি স্থাপন করলেন। বাবার বই নিতান্ত কম ছিল না, সাহিত্য ছাড়াও বিজ্ঞান ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রভৃতি নানা বিষয়ে বাংলা ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় বাছা বাছা প্রচুর বই ছিল। সেইজন্য গোড়া থেকেই বেশ উঁচুদরের ভালো একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছাত্র নেই, ছাত্রাবাস নেই— বিদ্যালয়ের ভিতপত্তন হল এই লাইব্রেরি দিয়ে।” বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় এটা জেনে যে, আজ যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল মহীরূহ-বিশ্বভারতী, কিংবা অতীতে চল্লিশ বছর ধরে নির্মীয়মাণ রবীন্দ্রনাথ-পরিচালিত ব্রহ্মবিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী— তার এক দিন ভিতপত্তন হয়েছিল একটি লাইব্রেরি দিয়ে!

এখানেই এক সময় স্থান পেয়েছিল মহর্ষির ব্যবহৃত গ্রন্থ, ব্রাহ্মসমাজের মূল্যবান পত্র-পত্রিকা, এমনকি রবীন্দ্রনাথের নিজের সমৃদ্ধ গ্রন্থ-সংগ্রহ। পরবর্তী কালে যুক্ত হয়েছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর নিজস্ব সংগ্রহ এবং শান্তিনিকেতন, কলকাতা-সহ দেশ-বিদেশের বহু জ্ঞানতপস্বী সাধক মনীষীদের অমূল্য গ্রন্থ-সম্ভার। এমন নজিরও আছে যে, কবি স্বয়ং বন্ধু প্রিয়নাথের বিয়োগের পরে, তাঁর মূল্যবান লাইব্রেরিটি কিনে নিয়েছিলেন। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, গুণী মানুষদের ব্যক্তিগত গ্রন্থ-সংগ্রহ দান প্রক্রিয়াটি বর্তমান বিশ্বভারতীতে আজও রবীন্দ্রযুগের মতোই অব্যাহত। ওই মূল্যবান গ্রন্থ-সংগ্রহের কিছু কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, কিছু ভবন গ্রন্থাগার এবং অধিকাংশই পাওয়া যায় রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগারে। মূলত এই সমস্ত গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণার দিক-দিগন্ত প্রসারিত করে চলেছে। এর পরেও বছর বছর ধরে সরকারি অনুদানে কেনা আধুনিক বিষয়-কেন্দ্রিক গ্রন্থসংগ্রহ নিয়ে বিশ্বভারতীতে আজ গ্রন্থ-সংখ্যা প্রায় ন’লক্ষের কাছাকাছি!

এত এত গ্রন্থের সদ্ব্যবহার একটি বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে আজ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার-সহ মোট বারোটি গ্রন্থাগার, বিভাগ ও বিষয় অনুসারে রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছে।

লেখক বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র-গবেষক এবং রবীন্দ্রভবনের গ্রন্থাগার কর্মী, মতামত নিজস্ব

অন্য বিষয়গুলি:

Library School Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy