Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

ভোট গিয়েছে, মোদীর দেখানো স্বপ্নের নটেগাছটিও মুড়িয়েছে

আসল কারণ— শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি, শ্রেণিবৈষম্য। মুখে যাই বলুক না-কেন, মোদী সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় গরিব, খেটেখাওয়া মানুষ যে নেই, তা লকডাউন পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। লিখছেন অনির্বাণ দাশগুপ্তআজ দেশব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের আবহে ভারত দেখছে আর একটি লং মার্চ। সেই লং মার্চ পরিযায়ী শ্রমিকদের।

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০১:৫১
Share: Save:

কয়েক বছর আগে মহারাষ্ট্রে কৃষকদের লং মার্চ দেখেছিল ভারত। মরাঠা-ভূমে প্রত্যন্ত গ্রামগুলি থেকে হাজার হাজার কৃষক নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য হাজির হয়েছিলেন মুম্বইয়ে। লাঙল ধরা কড়া হাতে লাল ঝান্ডা নিয়ে কৃষকদের সেই মহামিছিল চমকে দিয়েছিল গোটা দেশকে।

আজ দেশব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের আবহে ভারত দেখছে আর একটি লং মার্চ। সেই লং মার্চ পরিযায়ী শ্রমিকদের। যাঁরা লকডাউনের কারণে কাজ খুইয়েছেন, টাকা দিতে না-পারার জন্য যাঁদের উৎখাত করেছেন বাড়িওয়ালা, দৈনিক গ্রাসাচ্ছাদনও অনিশ্চিত। প্রকৃত অর্থেই সর্বহারা এই শ্রমিককূল প্রাণ বাঁচাতে নিজভূমে ফেরার মরিয়া চেষ্টা করছেন। পথ অগম্য জেনেও কয়েকশো কিলোমিটার পাড়ি দিতে চাইছেন পদব্রজেই। ক্লান্তিতে পথেই প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে, সেই তালিকায় ১২ বছরের কিশোরী জামলো মকদম যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধও। ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে চিরদিনের মতো পরিযায়ী হয়ে গিয়েছেন ১৬ জন শ্রমিক। আরও বহুজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন এই ক’দিনে পথ দুর্ঘটনায়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, ‘‘আমার স্বপ্ন হাওয়াই চটি পরা মানুষগুলিকে হাওয়াই জাহাজে (বিমানে) চড়ানো।’’ সে দিন তুমুল হাততালি পেয়েছিলেন মোদী, হাত উপুড় করে গরিব-গুর্বো মানুষগুলো তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন ‘অচ্ছে দিনে’র স্বপ্নে। ভোট গিয়েছে, মোদীর দেখানো স্বপ্নের নটেগাছটিও মুড়িয়েছে।

পরিযায়ী শ্রমিকেরা কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন, সে ব্যাপারে কোনও সুষ্ঠু সমাধানের কথা শোনা যায়নি লকডাউনের দেড় মাস কাটার পরেও। কেন্দ্র বলল, শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য যে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার ভাড়া দিতে হবে শ্রমিকদেরই। কিন্তু বিদেশে আটকে পড়া ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে মে মাসের আগে পর্যন্ত কোনও যাত্রীকে একটি টাকাও খরচ করতে হয়নি। চিনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কারণে গোটা উহান শহর লকডাউন করায় বহু ভারতীয় আটকে পড়েছিলেন। পরে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে তাঁদের দেশে ফেরানো হয়। একই ভাবে ব্রিটেন, ইরান, ইটালিতে আটকে পড়া ভারতীয়দেরও বিমানে করে ফেরানো হয়েছে। সে জন্য একটি টাকাও খরচ হয়নি বিদেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের। এয়ার ইন্ডিয়া বিমানের ঘণ্টা প্রতি ভাড়া এবং বিদেশের বিমানবন্দর ব্যবহারের পুরো খরচ এয়ার ইন্ডিয়াকে মিটিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। ঘরমুখী শ্রমিকদের রেল ভাড়া কংগ্রেস মেটাবে বলে সনিয়া গাঁধী ঘোষণা করার পরে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু একটি বারের জন্যও বলেনি বিদেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের যেমন নিখরচায় ফেরানো হয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকদেরও তেমন ভাবে ফেরানো হবে।

আসল কারণ— শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি, শ্রেণিবৈষম্য। মুখে যাই বলুক না-কেন, মোদী সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় গরিব, খেটেখাওয়া মানুষ যে নেই, তা লকডাউন পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ঘোষণার মাত্র চার ঘণ্টা ব্যবধানে দেশে লকডাউন জারি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের কী হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের যুক্তি ছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের এক জায়গায় আটকে রাখলে সংক্রমণের আশঙ্কা কমবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও খারাপ, ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে তাঁদের একটা বড় অংশ আয়ের পথ হারিয়েছে। বহু শ্রমিকের মাথার উপর থেকে ছাদ চলে গেলেও সরকার কার্যত দর্শকের ভূমিকায় থেকেছে। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র জানিয়েছিল, আটকে পড়া শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে কেন্দ্রের ওই দাবির সঙ্গে বাস্তবের ফারাক আকাশপাতাল। গত ১২ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে করা আমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের একটি সমীক্ষা বলছে, শহরের গরিব পরিবারগুলির ৭৪ শতাংশ নিয়মিত রোজগার হারিয়েছে। ৬০ শতাংশ জানিয়েছে, আর এক সপ্তাহ চালানোর মতো খাদ্য তাদের কাছে রয়েছে। দিল্লির একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৬০ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক বলছেন, তাঁরা খাবার পাচ্ছেন কোনও না কোনও বেসরকারি সংগঠনের কাছ থেকে, সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে নয়।

পরিযায়ী শ্রমিকেরা যখন অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন তখন প্রধানমন্ত্রী কখনও বলেছেন মোমবাতি জ্বালাতে। কখনও বলছেন হাততালি বা থালি বাজাতে। আবার কখনও পরিযায়ী শ্রমিকদের মন ভাল রাখার দাওয়াই দিচ্ছেন। এ সব উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকেই মনে করেন, পরিকল্পনা না-করে, তাড়াহুড়ো করে লকডাউন জারি করা হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে কেন্দ্রের মনোভাব এবং শ্রম আইন নিয়ে তারা যে পথে এগোচ্ছে, তা থেকে স্পষ্ট, সচেতন ভাবেই এই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে এটা করা হয়েছে, যখন কোনও প্রতিবাদ করা যাবে না, কোথাও জড়ো হওয়া সম্ভব নয়।

পরিযায়ী শ্রমিকেদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে কেন্দ্রের উদাসীনতার মূল কারণ মালিক স্বার্থ। লকডাউন ওঠার পরে নির্মাণ-শিল্প, কলকারখানায় শ্রমিকের অভাব যাতে না-হয় তা নিশ্চিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বিজেপি শাসিত কর্নাটক এবং গুজরাতে সেই পরিকল্পনা তো প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। অতিমারির কথা বলে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। তারা শ্রম আইন তুলে দেওয়া বা তা স্থগিত রাখার কথা বলছে। দেশের বণিক মহল কেন্দ্রের কাছে যে দাবি জানিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, দেশের শ্রম আইন আগামী তিন বছরের জন্য তুলে দিতে হবে। শিল্পে আর্থিক সমস্যার কথা মাথায় রেখে শ্রমিকদের মজুরি আলাদা করে না-দিয়ে কর্পোরেট সামাজিক সাহায্য তহবিল (সিএসআর) থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অবাধ ছাঁটাইয়ের সুযোগ থাকার কথাও বলা হয়েছে। প্রতি দিন আট ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা কাজের দাবিও রয়েছে। গুজরাত সরকার তো ইতিমধ্যেই তা চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে।

অতিমারির বোঝা শ্রমিক শ্রেণির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে কেন্দ্র। ইউরোপের বহু দেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে শ্রমিকদের মজুরি ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইল্যান্ডের মতো বহু দেশ ওই পথে হেঁটেছে। ব্যতিক্রম, আমেরিকা ও ভারত।

প্রধানমন্ত্রী মুখে যাই বলুন না কেন, এক দিকে ধনী-কর্পোরেটদের রক্ষা, অবাধ ছাড় আর অন্য দিকে গরিব ও মধ্যবিত্তকে ভাতে মারার ব্যবস্থায় বিভাজনের রেখাটা কিন্তু সুস্পষ্ট।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy