মঙ্গলবার মধ্যনিশির হানায় সিবিআই দফতরের দুই সংঘর্ষরত শীর্ষনেতার অফিসে তালাচাবি দিবার ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যুক্তি: ইহা একটি বেনজির পরিস্থিতির কারণে গৃহীত বেনজির সিদ্ধান্ত। সন্দেহ নাই, পরিস্থিতি এ বার আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব। গত কয়েক দশকে সিবিআই-এর কাজকর্ম লইয়া অভিযোগ-আশঙ্কা কিছু কম দেখা যায় নাই, কিন্তু এই বারের সিবিআই বনাম সিবিআই দ্বন্দ্বের আশ্চর্য রূপটি এই ঘটনাবহুল দেশেও অদেখা বলিতে হইবে। অধিকর্তা অলোক বর্মা এবং বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানা দুই জনকেই আপাতত ছুটিতে পাঠাইয়া দেশের মুখ্য সরকারি তদন্ত সংস্থার অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব দেওয়া হইল কয়েক ধাপ নীচের পদাধিকারী এম নাগেশ্বর রাওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষুব্ধ বর্মা বুধবার সকালেই সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছেন। অভিযোগ: তাঁহার বিরুদ্ধে গৃহীত সিদ্ধান্ত ‘বেআইনি’, কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন, কাহারও এ কাজ করিবার এক্তিয়ার নাই। ‘অতি-সংবেদনশীল’ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে বলিয়া তাঁহার বিশ্বাস। বাক্যটির মধ্যে যে রাজনৈতিক সন্ধান, বিরোধী দলগুলির বক্তব্যে তাহারই স্পষ্টতর প্রকাশ— রাফাল তদন্ত যাহাতে বিপজ্জনক মোড় না লয়, সেই কারণেই নাকি বর্মাকে এই ভাবে রাতারাতি ছুটিতে যাইতে হইল। রাহুল গাঁধী হইতে ডিএমকে সভাপতি স্ট্যালিন অনেকেই এই অভিযোগ তুলিয়াছেন। অভিযোগ সত্য হউক না হউক, ইতিমধ্যে সিবিআইয়ের অন্দরে যাহা কিছু ঘটিয়া গিয়াছে— যে ভাবে রীতিপদ্ধতি অমান্য করিয়া আস্থানাকে এই পদে আসীন করা হইয়াছিল, যে ভাবে সদ্য-প্রাক্তন অধিকর্তা বর্মা স্বয়ং সদ্য-প্রাক্তন বিশেষ অধিকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, যে ভাবে সদ্য-স্থানান্তরিত সিবিআই কর্তারা সহকর্মীদের বিরুদ্ধে হানার নির্দেশ দিয়াছিলেন— বুঝিতে বাকি থাকে না যে, সরষের ভিতরে ভূত কী প্রবল দাপটে রাজ্যপাট খুলিয়া বসিয়াছিল। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালেই সিবিআইকে খাঁচার তোতাপাখি বলিয়াছিল। বর্তমান ঘটনায় কেবল প্রমাণ হইল তোতাপাখিদের অবধারিত পরিণতি। খাঁচার মুরুব্বিয়ানা লইয়া অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সিবিআই-এর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হইয়াছে।
রাকেশ আস্থানা কিংবা অলোক বর্মা, ইঁহারা কে কতখানি রাজনৈতিক স্বার্থ বহন করিতেছেন, কিংবা তুলনামূলক ভাবে নাগেশ্বর রাও কতখানি বেশি বা কম দুর্নীতিগ্রস্ত, এই সব প্রশ্ন গুরুতর, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অপেক্ষাও গুরুতর একটি কথা আছে। পূর্বতন সরকারগুলিও সিবিআইকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করিয়াছে, শুধুমাত্র এই যুক্তিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার অপপ্রয়াসকে ছোট করিয়া দেখা কার্যত অসম্ভব। কেননা আস্থানাকে এই সংস্থায় লইয়া আসিবার পর পরই তিনি যে ভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তা অর্থাৎ বর্মাকে উপেক্ষা করিয়া বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত মামলাগুলিতে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানের নীতিবিরুদ্ধতা ছিল না, সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার লক্ষ্যও ছিল বলিয়া অভিযোগ। বাস্তবিক মোদী সরকারের বিশেষত্বই ক্রমাগত প্রতিহিংসার রাজনীতির মাধ্যমে বিরোধীদের বিপন্ন করা। সেই কাজে দেশের প্রধান তদন্ত সংস্থাটিকে যথেচ্ছ ‘ব্যবহার’ করা হইতেছিল, ইহা প্রায় নিশ্চিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিস্বরূপ প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমান সরকারের প্রযত্নে এই ভাবেই বিনষ্টির সম্মুখীন। বিনষ্টির ধরনটি এমনই মারাত্মক যে তাহাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়া পাইবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বর্তমান কুনাট্যের পর আবারও যদি সিবিআই নামক প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা ফিরাইয়া আনিতে হয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকারকে সম্পূর্ণত হাত উঠাইয়া লইতে হইবে— যে সম্ভাবনা ক্ষীণতর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy