Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

নবাবের সেই মিছিলের জাঁক ছিল দেখার মতো

নবাবের মাথায় মসলিনের পাগড়ি। সেই পাগড়ি প্রায় চুয়াল্লিশ হাত লম্বা ও ওজন চার থেকে পাঁচ গ্রাম। পাগড়ির সামনে দিকে বসানো রয়েছে একটি মূল্যবান হিরে। লিখছেন ফারুক আব্দুল্লাহপ্রাসাদে ছিল সাদা মার্বেল পাথরের নির্মিত চমকপ্রদ খিলান বিশিষ্ট স্তম্ভ।

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৯ ০২:৪২
Share: Save:

১৭৭০ সালের ১০ মার্চ, শনিবার নবাব মিরজাফর ও মুন্নি বেগমের পুত্র সাইফ-উদ-দৌলা বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাংলার মসনদে বসেন মিরজাফরের অপর পত্নী বাব্বু বেগমের ছেলে মোবারক-উদ-দৌলা। কিন্তু তাঁর আমল থেকেই নানা কারণে মুর্শিদাবাদের পূর্ব গৌরব ম্লান হতে শুরু করে।

কিন্ত তার পরেও তাঁর নবাবিয়ানা কোনও অংশেই কমেনি। নবাব মোবারক-উদ-দৌলার আমলে কেমন ছিল রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহর এবং নবাবি আভিজাত্য? সেই বিষয়ে প্রাপ্ত নানা তথ্যের মধ্যে রয়েছে তৎকালীন মুর্শিদাবাদ শহরে আসা দু’জন ভ্রমণকারীর বর্ণনা। এক জন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যংলো ইন্ডিয়ান সৈনিক শেখ দীন মহম্মদ, অন্য জন উইলিয়াম হিকি নামে এক

ইংরেজ আইনজীবী।

শেখ দীন মহম্মদ তাঁর বই ‘The Travels of Dean Mahomet— এ মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটি তিনি চিঠির আকারে লিখেছেন। একটি চিঠি একটি প্রচ্ছদ। ১১ নম্বর চিঠিতে লেখকের মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লেখা রয়েছে। শেখ দীন মহম্মদের বিবরণ অনুসারে, তিনি ১৭৭৩ সালের কোনও এক দিন রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহর দেখতে যান এবং শহরের বিশালতা দেখে মুগ্ধ হন। মুর্শিদাবাদ শহরকে তিনি একটি বাণিজ্যিক শহর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, মুর্শিদাবাদ শহর দেশীয় মানুষদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত স্থান। সেখানে মুঘল, পার্সি, মুসলিম, হিন্দু সবার অবাধ বিচরণ। এই শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কিন্ত গোছানো নয়। তবে শহরের ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলি নকশা অনুযায়ী ও উন্নত ইট দিয়ে তৈরি। শহরে শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদেরই নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বাড়িগুলিও ছিল বেশ ছিমছাম। মুর্শিদাবাদ শহর ও শহরতলি মিলিয়ে লম্বায় ছিল নয় মাইল। এই বিস্তৃত এলাকার মধ্যবর্তী ফাঁকা অঞ্চলে ছিল নবাব মোবারক-উদ-দৌলা-সহ তাঁর উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের প্রাসাদ। তবে নবাবের প্রাসাদ ছিল সবার থেকে আলাদা। প্রাসাদে ছিল সাদা মার্বেল পাথরের নির্মিত চমকপ্রদ খিলান বিশিষ্ট স্তম্ভ। তাতে ছিল নানা রঙের পর্দা লাগানো। প্রাসাদের খিলানে দেশীয় বাদকেরা প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় নানা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে সুমধুর সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। প্রাসাদের এক পাশে ভাগীরথী এবং অন্য পাশে চক (ফার্সি ভাষায় যার অর্থ বাজার)। যেখানে ঘোড়া, বাজপাখি, গান গাওয়া পাখি সব কিছুরই বিকিকিনি চলত।

দীন মহম্মদ লিখেছেন যে, নবাবের জাঁক দেখে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তিনি হঠাৎ দেখেন যে, নবাব তাঁর তিন হাজার সঙ্গী নিয়ে একটি রাজকীয় মিছিল করে নিজের এলাকার একটি মন্দির দর্শনে যাচ্ছেন। প্রত্যেকের পরনেই রাজকীয় পোশাক। এই বিশাল মিছিলই তাঁর জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ মিছিল। একটি বড় পালকিতে নবাব মোবারক-উদ-দৌলা বসে আছেন। সেই পালকি বয়ে নিয়ে চলেছেন লাল পোশাক পরিহিত ষোলো জন বেহারা। পালকির শামিয়ানা খুব উজ্জ্বল রঙের। তাতে রয়েছে রুপোর নকশা। পালকিটি দেখতে অনেকটা ডিম্বাকার এবং হাতলওয়ালা চেয়ারের মতো। নবাব নাজিম সেখানেই দু’পা মুড়ে নরম বালিশে গা এলিয়ে বসে আছেন। নবাবের চেয়ারের দু’পাশের হাতলগুলিও সোনার কাজ করা দামী ভেলভেট কাপড়ে মোড়া। নবাবের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন। তাঁরা চামর দুলিয়ে মাছি তাড়িয়ে চলেছেন। এই চামরের হাতলগুলিও

রুপোর তৈরি।

লেখক জানাচ্ছেন, নবাবের মাথায় মসলিনের পাগড়ি। তাঁর অনুমান, সেই পাগড়ি প্রায় চুয়াল্লিশ হাত লম্বা ও ওজন হবে মাত্র চার থেকে পাঁচ গ্রাম। পাগড়ির সামনের দিকে পাড় বরাবর রয়েছে ছোট ছোট ঝালর যা নবাবের ডান চোখের উপর পড়ছে। পাগড়ির সামনে দিকে বসানো রয়েছে একটি মূল্যবান হিরে। নবাবের পরনে মসলিন কাপড়ের পাতলা পোশাক এবং তার উপরে রয়েছে ক্রিম রঙের রেশমি কাপড়ের লম্বা আলখাল্লা এবং ওই একই কাপড়ের তৈরি পাজামা। নবাবের পোশাকের ধারগুলো ছিল রুপোতে মোড়া এবং পোশাকের প্রতিটি বোতামও ছিল রুপোর। উটের পশম দিয়ে তৈরি একটি বহুমূল্য শাল নবাবের কাঁধে রাখা আছে। অপর একটি শাল তার কোমরে জড়ানো। সেখানে গুঁজে রাখা আছে নবাবের তরবারি। তরবারির হাতলটি সোনার। সেখানে হিরে বসানো এবং ছোট ছোট সোনার চেন লাগানো। নবাবের জুতোও লাল ভেলভেটের এবং তার চারিধারও রুপোয় মোড়া ও

মুক্ত বসানো।

এই মিছিলে দু’জন উচ্চপদস্থ আধিকারিক ঘোড়ায় চড়ে নবাবের দু’পাশে চলছেন। ঘোড়ায় উপবিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে নবাবের পোশাকের তেমন কোনও পার্থক্য নেই, শুধুমাত্র পাগড়ির হিরেটি ছাড়া। নবাবের সামনে এবং পিছনে রয়েছে অসংখ্য সৈন্য। এ ছাড়া নবাবের সিংহাসনের কাছাকাছি ঘুরছেন নবাবের দেহরক্ষীরা। নবাবের হাতে সোনা ও হিরের কারুকার্য খচিত হুঁকোর নল।

সমগ্র মিছিলে রয়েছে দেশীয় বাদকদের একটি দল। সেই সঙ্গে উটের পিঠে রয়েছে বিরাট আকারের একটি ঢোল। বহু দূর থেকেও যার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়াও মিছিলের আগে যাচ্ছেন ঘোষকেরা। তাঁরা নবাবের আসার আগাম খবর ঘোষণা করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। এই নবাবি মিছিল দেখতে সাধারণ মানুষের ভিড় শুরু হয়েছে। এর পরে দীন মহম্মদ লিখছেন যে, তিনি নবাবের সঙ্গীদের নিয়ে মন্দিরে ঢোকার অপেক্ষা করতে লাগলেন। এবং দেখলেন যে, সবাই মন্দির চত্বরে প্রবেশের আগেই বাইরে জুতো খুলে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করলেন। দীন মহম্মদ নবাব মোবারক-উদ-দৌলার এই জাঁকজমকপূর্ণ জুলুষ বা মিছিলে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি আরও কিছু দিন মুর্শিদাবাদে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নবাব মোবারক-উদ-দৌলার আমলের মুর্শিদাবাদের বর্ণনা উইলিয়াম হিকি নামে এক ইংরেজ আইনজীবীর স্মৃতিকথা থেকেও পাওয়া যায়। হিকি তাঁর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘Hickey’s Memoirs’ নামে একটি বই লেখেন। যেখানে স্থান পেয়েছে তাঁর মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের নানা স্মৃতিকথা। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর বন্ধু রবার্ট পট নবাব মোবারক-উদ-দৌলার দরবারে রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই বন্ধুর কাছে বেড়াতে এসেই হিকির প্রথম মুর্শিদাবাদ দর্শন।

হিকি লিখছেন যে, মুর্শিদাবাদে তাঁর নানা স্মৃতির মধ্যে বাংলার নবাব মোবারক-উদ-দৌলার প্রাসাদে বেড়াতে যাওয়ার কথা বিশেষ ভাবে মনে আছে। নবাব প্রাসাদে যাবার আগের দিন রেসিডেন্ট রর্বাট পট নবাব নাজিমকে খবর পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি তার বিশেষ অন্তরঙ্গ এক বন্ধুকে নিয়ে পরের দিন সকালে তাঁর প্রাসাদে দেখা করতে যাবেন। এবং তাঁর সঙ্গেই প্রাতঃরাশ সারবেন। নির্দিষ্ট দিনে সকালে তাঁরা নবাবের প্রাসাদে পৌঁছন। নবাব তাঁদের সাদর অভিনন্দন জানিয়ে প্রাসাদে নিয়ে যান। সাহেবি রুচি অনুযায়ী নবাব তাঁদের জন্য প্রাতঃরাশের চমৎকার আয়োজন করেছিলেন। নবাবি জীবনযাত্রার নানা বিচিত্র উপকরণ দেখে হিকি রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন।

এর ঠিক তিন দিন পরে সামাজিক শিষ্টতা বজায় রাখার জন্য নবাব মোবারক-উদ-দৌলা একটি জাঁকজমকপূর্ণ জুলুষ বা মিছিল সহযোগে রেসিডেন্ট পটের আফজালবাগের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করে আসেন। সেই রাতেই হিকিরা সদলবলে নবাবের প্রাসাদে গিয়ে নৈশভোজ সারেন। সেই সঙ্গে চমৎকার আতসবাজির খেলা দেখেন।

শিক্ষক, এসসিবিসি কলেজ, লালবাগ

অন্য বিষয়গুলি:

Nawab Murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE