হায়দরাবাদে এনকাউন্টারে নিহত। —ফাইল ছবি
সংশয় আছে, স্বেচ্ছাচারিতা আছে আর আছে নৈরাজ্যের অশনি সঙ্কেত। এমন সংশয় কি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় যে, হয়তো কাউকে আড়াল করার তাগিদেই পুলিশের এমন চটজলদি ‘এনকাউন্টার’! ২৮ নভেম্বরের সেই রাতে ঠিক কারা এমন পৈশাচিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করেছিল, সেটাও কিন্তু খুব স্পষ্ট নয়। কারণ, যাদের অপরাধী বলে মনে করা হচ্ছে, তারাই যে প্রকৃত অপরাধী এমন তথ্যপ্রমাণ কিন্তু পুলিশ এখনও আদালতে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। যাদের অপরাধী বলে দেখানো হচ্ছে, তারাই যে প্রকৃত অপরাধী এমন কথা কিন্তু এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র পুলিশই বলেছে, আদালত নয়। ফলে পুলিশের এই অতিসক্রিয় ‘এনকাউন্টার’-এর মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হল কিনা সে কথাও কিন্তু এখনও পর্যন্ত অধরা থেকে গেল।
এ কথা সকলেরই জানা যে, পুলিশ রাষ্ট্রশক্তির অঙ্গুলিহেলনে নড়ে এবং চড়ে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে পুলিশ তার ‘ট্রিগার হ্যাপি’ দর্শন মেনে আজ কয়েকটা ‘অমানুষ’কে হত্যা করে মহান কাজ করেছে, কে বলতে পারে যে আগামী দিনে পুলিশ সেই একই দর্শন মেনে এমন অনেক প্রতিবাদী ‘মানুষ’কে হত্যা করার স্পর্ধা দেখাবে না? সেই সঙ্গে এ কথাও বিবেচনার আওতায় আনা প্রয়োজন যে, পুলিশ কিন্তু তার এই ‘এনকাউন্টার তত্ত্ব’ কোন প্রভাবশালী ধর্ষক ও খুনির ক্ষেত্রে কখনও প্রয়োগ করেনি। এমন বেশ কয়েক জন শাসকদলের সান্নিধ্যে থাকা বিচারাধীন ধর্ষক ও খুনি কিন্তু আজও কারাগারে অথবা সমাজের অলিন্দে রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে পুলিশ কি এই ‘এনকাউন্টার তত্ত্ব’ প্রয়োগের স্পর্ধা দেখাতে পেরেছে?
তা হলে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরের মানুষেরাই পুলিশের এই ‘এনকাউন্টার তত্ত্বে’ কেনই বা এত উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লেন? আপামর ভারতবাসী কি জানেন না যে, পুলিশের এই এনকাউন্টারের তত্ত্ব শুধুমাত্র সংবিধান বিরোধীই নয়, চরম মানবতা বিরোধীও! কারণ, নররূপী পিশাচরা যে পৈশাচিক কর্মকাণ্ড অবলীলায় সাঙ্গ করতে পারে, সভ্যসমাজ বা সভ্যসমাজ পরিচালনকারী রাষ্ট্র কখনও তা করতে পারে না। তবু কেন এত উচ্ছ্বাস, কেনই বা এত প্রশংসা বর্ষণ! তা কি শুধুমাত্র পুলিশকৃত ‘ইনস্ট্যান্ট জাস্টিস’-এর উন্মাদনায়? নাকি তা ‘অতি সক্রিয়’ পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা প্রদর্শন? আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও, অন্তর্নিহিত প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, আদতে তা কিন্তু মোটেই নয়। অগণিত আমজনতার এই বাঁধনহারা সমর্থন আসলে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতি তীব্র অবিশ্বাসেরই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। জনতা জানেন এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে বিশ্বাস করেন যে, এমন এক নারকীয় ঘটনার পরেও পুলিশ ঠিক সময়ে চার্জশিট দিতে অসমর্থ হবে, তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে অপটুতা দেখাবে এবং অনেক অজানা কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। ফলে ‘জাস্টিস’ অধরাই থেকে যাবে। তাই এইসকল নররূপী পিশাচরা যদি পুলিশের পরিবর্তে কোনও অরণ্যদেব বা জেমস বন্ডের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেত, হলফ করে বলতে পারি লক্ষকোটি মানব মনন একই রকম স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের বন্যায় প্লাবিত হত।
তাই পুলিশের এই অতিসক্রিয় বাহাদুরি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণযোগ্যতার প্রধান কারণ হল পুলিশ-প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের প্রবল অনাস্থাজ্ঞাপন। আর এই অনাস্থা কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক নয়। সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের চরম ঢিলেমি এবং ক্ষমাহীন অপদার্থতা, বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন পুলিশের ওপর প্রবল রাজনৈতিক চাপ, পুলিশের একাংশের অসৎ প্রবৃত্তি, ওকালতির চাতুর্যে বিচার প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত বিলম্বিত করা ইত্যাদি শুধুমাত্র বিচার প্রক্রিয়াকেই উপহাসযোগ্য করে তোলে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতিতাকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে। এমন অজস্র উদাহরণ সমাজের সকল স্তরের মানুষের মনে বিচার ব্যবস্থার প্রতি এই অনাস্থার অন্যতম কারণ। নির্ভয়া কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত দোষীরা শাস্তি পায়নি, কামদুনি কাণ্ডে প্রাথমিক ভাবে বিচার পেয়েও অন্তিম বিচার এখনও অধরাই থেকে গিয়েছে, উন্নাও কাণ্ডে অপরাধীরা বারবার নির্যাতিতাকে প্রাণে মেরে ফেলার স্পর্ধা দেখিয়েও এখনও দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়নি, অভিযুক্তেরা জামিনে ছাড়া পেয়েই উন্নাওয়ের আর এক ধর্ষিতাকে প্রকাশ্যে জীবন্ত জ্বালিয়ে মেরে ফেলার জ্বলন্ত উদাহরণ— এমন একের পর এক বিচারহীন বিচার প্রক্রিয়া দেখে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। যার ফলস্বরূপ তাঁরা সমবেত ভাবে পুলিশের এই ‘এনকাউন্টারের তত্ত্বে’ সিলমোহর লাগিয়ে আসলে আমাদের এই পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশ-প্রশাসন এবং জ্বরাগ্রস্থ বিচার ব্যবস্থার প্রতি চরম অনাস্থা প্রকাশ করছেন। করবেনই না বা কেন?
যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে কোনও একটি সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলের সরকার গঠনের পথ মসৃণ করার তাগিদে মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান ঘটাতে পারেন, সেই মহামান্য রাষ্ট্রপতিই নির্ভয়া কাণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর প্রাণভিক্ষার আর্জি নাকচ করতে অবলীলায় দিনের পর দিন সময় অতিবাহিত করেন! দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি যুদ্ধকালীন ক্ষিপ্রতায় অযোধ্যা মামলার শুনানির ব্যবস্থা করতে পারেন, অথচ নারকীয় ধর্ষণ এবং খুনের মামলার শুনানি অবলীলায় তারিখের পর তারিখে বয়ে যেতে দেখেও কোন সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার বার্তা রেখে যেতে পারেন না!
এমনই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও যে কোনও গণতান্ত্রিক মানসিকতায় সংপৃক্ত নাগরিকদের কাছে এটাই কাম্য, যাতে এমন নররূপী পিশাচদের দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপযুক্ত দণ্ডাদেশ দেওয়া যায়। আর যথোচিত সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতের সামনে পেশ করে অপরাধীকে আইন মোতাবেক দ্রুত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করাই কোনও গণতান্ত্রিক দেশের পুলিশের একনিষ্ঠ কাজ। শাস্তি বিধানের মূল উদ্দেশ্য একদিকে যেমন অপরাধীকে তাঁর অপরাধের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা, ঠিক তেমনই বাকি সমাজকে অপরাধ থেকে বিরত থাকার বার্তা দেওয়া, নচেৎ একই রকম শাস্তি তাঁকেও পেতে হবে। এই শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া যত দিন না দ্রুত সম্পন্ন হবে, সমাজে এই ধরনের এনকাউন্টারের পক্ষে তত বেশি জনমত তৈরি হবে। যা কিনা পুলিশকে অত্যুৎসাহী ‘ট্রিগার হ্যাপি’ দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার আশঙ্কা জাগিয়ে রাখবে ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার প্রবল চাপে এমন এনকাউন্টারের উদাহরণ হাটে, মাঠে, ঘাটে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়েই চলবে।
শিক্ষক, এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy