Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
পশ্চিমবঙ্গে বৃহত্তম শিল্পের নাম রাজনীতি, রোজগারও সেখানেই

বঙ্গে হিংসা ছাড়া গতি নেই

পশ্চিমবঙ্গ নামক শিল্পশ্মশানে বৃহত্তম শিল্পটির নাম এখন রাজনীতি। আর সেখানে সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা হল তৃণমূল কংগ্রেস। বড় হওয়ার কারণটা নিতান্ত সাদামাটা— তাদের হাতে ক্ষমতা।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৯ ০০:২০
Share: Save:

প্রথম দফা ভোটের আগে যা গুঞ্জন ছিল, সাতপর্ব নির্বাচন শেষ হয়ে ফল প্রকাশের পর সেই জল্পনার তীব্রতায় কান পাতা দায়— তৃণমূল কংগ্রেস স্বখাত-সলিলে ডুবেছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে কার্যত সরকারি তত্ত্বাবধানে রাজ্য জুড়ে যে তুমুল হিংসা হয়েছে, বিজেপির পালে হাওয়ার পিছনে সেই অনাচারই দায়ী। তৃণমূল কংগ্রেস বেলাগাম হিংস্রতা করেছে বলেই দলে দলে মানুষ রাতারাতি বিজেপি হয়ে গেল, এই যুক্তির গোড়ায় অতিসরলীকরণ রয়েছে। বঙ্গবাসীর অন্তরে সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত কুলকুল না বইলে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির পিছনে দাঁড়িযে পড়া কঠিন ছিল। কিন্তু, সে তর্ক নয়। প্রশ্ন হল, চড়াম চড়াম ঢাক বাজিয়ে পঞ্চায়েত দখল করা ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের সামনে কি আর কোনও রাস্তা ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যায়। না। সর্বাত্মক হিংসা বই পথ ছিল না কোনও। তার কারণ রাজনীতিতে যতখানি, তার চেয়েও বেশি অর্থনীতিতে। পশ্চিমবঙ্গ নামক শিল্পশ্মশানে বৃহত্তম শিল্পটির নাম এখন রাজনীতি। আর সেখানে সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা হল তৃণমূল কংগ্রেস। বড় হওয়ার কারণটা নিতান্ত সাদামাটা— তাদের হাতে ক্ষমতা। সরকারি টাকাও তাদের হাতে, আবার সিন্ডিকেট করে টাকা তোলার জন্য যে ক্ষমতা প্রয়োজন, সেটাও তাদেরই। পার্টি করলে মাসে কয়েক হাজার টাকার ব্যবস্থা হয়েই যায়। পঞ্চায়েতের হাতে টাকা আছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার টাকা, ‘আনটায়েড ফান্ড’-এর টাকা। সেই টাকার নাগাল পেতে গেলে পঞ্চায়েতের বিজয়ী পক্ষে থাকতেই হবে। সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি আছে, আশা’র কাজ আছে, প্যারা-টিচারের পোস্ট আছে, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে সুযোগ আছে। ক্ষমতাসীন দলের খাতায় নাম লেখানো থাকলেই পাওয়া যেতে পারে এই সুযোগগুলো।

এই সুযোগ দেওয়ার ক্ষমতা আছে বলেই এত দিন ঝাঁকে ঝাঁকে লোক তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে মিছিলে হাঁটত। রোজগারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার পথ যদি উবে যায়, তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটাও ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতো। দলটার জন্মলগ্ন থেকে কোনও আদর্শের বালাই নেই— তাদের সর্বহারার একনায়কতন্ত্র নেই, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নেই, এমনকি বাঙালি খণ্ডজাতীয়তাও নেই। থাকার মধ্যে ছিল সিপিএম-বিরোধিতা— গত আট বছরে সে বালাইও চুকেছে। পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতাটুকু নষ্ট হয়ে গেলে দলকে ধরে রাখতে পারে, এমন কোনও দ্বিতীয় শক্তি তৃণমূলের চৌহদ্দিতে নেই। ঠিক সেই রাজনৈতিক তাগিদ থেকেই পঞ্চায়েত নামক রোজগারের উৎসগুলোকে ধরে রাখার বাধ্যবাধকতা। একটা পঞ্চায়েতে হেরে যাওয়া মানেই কয়েক কোটি টাকা হাতছাড়া হওয়া। আর তার মানেই বেশ কয়েকশো সমর্থক খোয়ানো— যার হাতে ক্ষমতা, যার কাছে থাকলে মাসে কয়েক হাজার টাকা রোজগারের সুযোগ, রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশ সেই দলের মিছিলেই হাঁটবেন।

বিজেপি যখন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন যে একটা পঞ্চায়েতও হাতছাড়া করা তৃণমূলের পক্ষে মারাত্মক হত, কথাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝেছিলেন। তার চেয়েও বেশি বুঝেছিলেন অনুব্রত মণ্ডলরা— একটা ছোট এলাকায় ক্ষমতা ধরে রাখাই যাঁদের রাজনীতির সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তারই ফল এক-তৃতীয়াংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়, বাকি আসনেও কার্যত তাই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত রাখঢাকহীন না হলেও নির্বাচনী সন্ত্রাস তো পশ্চিমবঙ্গ আগেও কম দেখেনি। বাম আমলেও দেখেছে, ২০১৬ সালের বিধানসভার আগেও দেখেছে। এই দফায় কী এমন হল যে রাজ্যে বিজেপির পক্ষে ভোট বেড়ে গেল ২২ শতাংশ? বামফ্রন্টকে কার্যত মুছে দিয়ে শক্তিতে প্রায় তৃণমূল কংগ্রেসের সমান হয়ে দাঁড়াল বিজেপি?

শুধুই ধর্মীয় মেরুকরণ? সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ? এটুকু দিয়ে গোটা ছবিটাকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। বরং প্রয়োজন রাজ্যে ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর চরিত্রটা বোঝা। অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই যে, ভারতীয় রাজনীতি এখন মূলত পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। পাওয়ার, এবং পাইয়ে দেওয়ার, জন্য একটা পরিচিতির সমতা প্রয়োজন। যেমন, জাতপাতভিত্তিক রাজনীতির সাফল্যের পিছনে ছিল জাতের পরিচিতির ভিত্তিতে পাইয়ে দেওয়ার গল্প। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অন্তত এত দিন অবধি জাতের অস্তিত্ব ছিল না তেমন। যা ছিল এবং আছে, তার নাম রাজনৈতিক পরিচিতি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তো বটেই, সমাজজীবনও রাজনৈতিক পরিচিতিকে কেন্দ্র করেই ঘুরেছে।

ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর মাঠে জাত বা অন্য কোনও পরিচিতিতে ঢুকতে না দেওয়ার, এবং রাজনৈতিক পরিচিতির জন্য দরজা হাট করে দেওয়ার কৃতিত্ব মূলত সিপিএম-এর প্রাপ্য। অস্বীকার করার উপায় নেই, তৃণমূল ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাইয়ে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা চালু করতে চেষ্টা করেছে— ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষোভের উৎস সেখানেই— কিন্তু, সেই পাইয়ে দেওয়া সরকারি, প্রশাসনিক স্তরে। দল তার সুবিধা পেতে চেয়েছে বিলক্ষণ, কিন্তু পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল সরকারের হাতে। তার বাইরে ‘পাইয়ে দেওয়া’র জন্য রাজনীতিই এখনও প্রধান পরিচিতি।

সিপিএম-এর আর একটা কৃতিত্বের কথা না বললে অন্যায় হবে। পার্টিকে সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান করার তাড়নায় সাড়ে তিন দশকে তারা রাজ্যের কোথাও অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রাখেনি। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ থেকে পঞ্চায়েত হয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসভা— সবের সুতো বেঁধে রেখেছিল পার্টি অফিসের দরজায়। ফলে, দলের বাইরে, সরকার-প্রশাসনের বাইরে এমন কোনও পরিসরই পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়নি, যেখানে সাধারণ মানুষ নিজের প্রয়োজনে পৌঁছতে পারে। খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, এই রাজ্যে এখনও কোনও শক্তিশালী অ-সরকারি সংস্থা নেই। ফলে, পশ্চিমবঙ্গ দু’দিক থেকেই ব্যতিক্রমী— বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো জাতপাতভিত্তিক ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর সুযোগও হয়নি, আবার কর্নাটকের মতো কার্যত রাজনীতিবিহীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও পায়নি। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ আটকে গিয়েছে রাজনৈতিক পরিচিতির খোপে।

নির্বাচন হল সেই রাজনৈতিক পরিচয়ভিত্তিক সমাজে ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র। বিনা রণে এই মেদিনীর সূচ্যগ্রপরিমাণও ছাড়া অসম্ভব। তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গে আর কোনও যুদ্ধ নেই। উত্তর বা পশ্চিম ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্যের খোঁজ নিলে দেখবেন, সেখানে একের পর এক হামলা হয়েছে জাতের পরিচিতির ভিত্তিতে— উঁচু জাতের মানুষ আক্রমণ করেছে নিচু জাতকে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে জাতপাতভিত্তিক হিংসার উদাহরণ কার্যত নেই। গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বেড়েছে বটে, কিন্তু তারও খোসা ছাড়ালেই রাজনীতির রং দেখা যায় স্পষ্ট।

বামের ভোট কেন রামে গেল, আর বিজেপি কী ভাবে প্রায় তৃণমূল কংগ্রেসের সমান সমান শক্তিধর হয়ে উঠল, এই দুটো প্রশ্নের উত্তর কার্যত এক সুতোয় বাঁধা। সুতোটা সম্পূর্ণ-রাজনীতিনির্ভর সমাজের। সেই গল্পটা ধরতে গেলে ২০১১ সাল থেকে শুরু করলে ভাল। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত বা ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির অস্তিত্ব ছিল অকিঞ্চিৎকর। তাদের দিকে ঝুঁকলে প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে, এই বিশ্বাসের কোনও কারণ ছিল না। বরং, আজ না হোক পরশুর পরের দিন সিপিএম আবার তার হারানো শক্তি ফিরে পেতে পারে, সেই ভরসা করা সহজতর ছিল। ২০০৯ সালে ৪৬.৬৭ শতাংশ লোক ভোট দিয়েছিলেন তৃণমূলকে, ৪৩.৩ শতাংশ দিয়েছিলেন বামফ্রন্টকে। ২০১১ সালে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৮.৪৫ শতাংশ, বামফ্রন্ট ৪১.০৫ শতাংশ। দুই বছরই অবশ্য তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ছিল, কিন্তু রাজ্যে তাদের নিজস্ব ভোট নিয়ে তর্কের বোধ হয় খুব প্রয়োজন নেই। এমনকি, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের ৪৫.৭১ শতাংশ ভোটের জবাবে বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট।

তার পরের তিন বছরে একেবারে পঞ্চায়েত স্তর থেকে বিজেপি নিজেদের অস্তিত্ব জোরদার করেছে— ক্ষমতা দখল করতে পারার মতো ভরসা তৈরি করতে পেরেছে। তার জন্য টাকা খরচ করেছে, সংগঠন তৈরি করেছে। অন্য দিকে, তৃণমূলের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের প্রত্যক্ষ সংঘাতের ফলে যাঁদের পক্ষে এত দিন সেই দলে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তাঁদের জন্য বিজেপি তৈরি করে দিয়েছে আনকোরা নতুন একটা পরিসর। যেখানে ঢুকে পড়তে কোনও বাধা নেই।

গত কয়েক দিনেই একটা কথা স্পষ্ট— রাজনৈতিক হিংসা, পার্টি অফিস দখল ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গে থামছে না। মাঝের বেশ কয়েক বছর তৃণমূল কার্যত একতরফা মেরেছিল। এ বার পাল্টা আক্রমণের শক্তি অর্জন করেছে বিজেপি। দখল নেওয়া ছাড়া তাদেরও গত্যন্তর নেই। কারণ, পাইয়ে দিতে হলে দখল রাখতেই হবে। আর, পাইয়ে দেওয়া ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি চলবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Politics Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE