মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ কী কী?
- পতনের কারণ স্যর, ইয়ে...
- এ দিকে আয়... প্যান্টটা খোল
- প্যান্ট স্যর... মানে, কাল ঠিক পড়ে আসব।
- এমন কাল কত গেল... এ দিকে আয় বলছি....
এর পর ক্লাস নাইনের ছেলেটির প্যান্ট অল্প নামিয়ে, গোটা ক্লাসের সামনে ছেলেটির পেছনে সপাট সপাট বেত পড়তে লাগল। মুঘল সাম্রাজ্য ইতিহাস বইয়ে অটুট, ছেলেটির ভবিষ্যতের উঠতি সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেল। বন্ধুরা বাছা বাছা রসিকতাও ছুড়ে দিতে থাকল তার দিকে। আর ছেলেটা? সে আজীবন অবিন্যস্ত হয়ে গেল। এটা যে খুব অচেনা গল্প, তা নয়। এমন ধরনের বহু শাস্তির গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুনেছি অনেককেই— ‘অমুক স্যর’ যা ছিলেন, করিডরে দেখলেই প্যান্টে... কিংবা অমুক দিদিমণি যা চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনাতেন, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসত।
অনেকে বলবেন, এতে হলটা কী? প্রায় সব ছেলেমেয়েই কমবেশি শাস্তি পেয়ে বড় হয়েছে। অন্যায় করলে তো শিক্ষকরা শাস্তি দেবেনই। নিশ্চয়ই। ভুল শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব তো তাঁদেরই। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে একটা প্রশ্ন উঠবে, ওই ছেলেটির প্রতি যা করা হয়েছিল, তা কি শাস্তি ছিল, না কি শাস্তির মোড়কে ঘোর অপমান? ঠিক যেমনটা হল সম্প্রতি তেলঙ্গানার এক স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী ইউনিফর্ম পরে আসেনি বলে শিক্ষিকা তাকে শাস্তি দেন— ছেলেদের বাথরুমের সামনে মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। বাথরুমে আসাযাওয়ার পথে স্কুলের ছোট-বড় ছেলেরা তাকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করে। মেয়েটি বাড়ি এসে ঘটনাটি জানায়। তার মা-বাবা স্কুলে গিয়ে অভিযোগ জানান। কিন্তু অপমান যা হওয়ার, তা হয়েই গেছে। মেয়েটি এখন আর স্কুল যেতে রাজি নয়।
রাজি হবেই বা কেন? তাকে তো শাস্তি দেওয়া হয়নি, অপমান করা হয়েছে। হ্যাঁ, অপমান। তার আত্মাকে ঘষে দেওয়া হয়েছে ছেলেদের বাথরুমের দেওয়ালে। তার আত্মবিশ্বাসকে ডলে দিয়েছে তার সহপাঠীদের ঠাট্টাতামাশার ফোয়ারা। এমন শাস্তি কেন? মেয়েটিকে লজ্জিত করতে। এ লজ্জা যেন সে কোনও দিন না ভোলে। কেবল বকাবকি করলে তো এই অপমান আর লজ্জা তাকে দগ্ধে দগ্ধে মারত না। এটা বেশ জম্পেশ একটা শাস্তি হয়েছে। যা তার সারা জীবন মনে থাকবে, আত্মবিশ্বাসকে ভেঙেচুরে দেবে, তাকে সবার চেয়ে কমতি ভাবতে শেখাবে। এই না হলে শাস্তি! এই না হলে শাস্তির মোড়কে তাগড়া অপমান!
অথচ, ‘শাস্তি’র কিন্তু এই বদনাম পাওয়ার কথা ছিল না। শিক্ষকরা ছাত্রদের দোষত্রুটি শুধরে দেওয়ার জন্য অনেক সময়েই হয়তো তাদের গায়ে হাত তোলেন, কান ধরে, চুল টেনে দুই চড়থাপ্পড় লাগান। সেটুকুও না করলেই ভাল— এ সত্য আমরা ক্রমশ বুঝতে শিখেছি যে, ছাত্রদের মেরে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিটা মোটেও ভাল নয়। আর যে শিক্ষকরা রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে বেদম মার মারেন, তাঁদের তো সমর্থন করার কোনও প্রশ্নই নেই। সে আঘাতে কেবল পিঠের বা হাতের ছাল ওঠে না, অনেক সময় সারা জীবনের জন্য মনের নুন-ছাল উঠে যায়, আর তাতে ঠুনকো আঘাত লাগলেও সে যন্ত্রণায় নীল হয়ে ওঠে শিক্ষক না চাইলেও হয়তো সেই শাস্তি ছাত্রের পক্ষে অপমান হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অপমান করবেন বলে শিক্ষক সে শাস্তি দেননি। সেটা রাগের মাথায় দেওয়া শাস্তি।
শাস্তি আর অপমানের এই সূক্ষ্ম তফাতটা বোঝা দরকার। সব শাস্তিই অপমান নয়। শাস্তির নামে আত্মবিশ্বাস এবং ছাত্রের নিজের সম্পর্কে ধারণাকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়াটা আসলে শাস্তি নয়, শাস্তিদাতার এক রকম প্রতিশোধ নেওয়ার পন্থা বলা যেতে পারে। কিংবা, হয়তো, অন্যের অপমান থেকে জাত প্রশান্তি!
যুক্তি উঠবে, কী করে জানব বাবা, যে ছেলেটি বা মেয়েটি এটুকু সহ্য করতে পারবে না? একটা সামান্য জিনিস নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করবে?
কেন জানবেন না? আপনারই তো ছাত্রছাত্রী। তাদের মনের কথা আপনি না জানলে তাদের শিক্ষক হওয়ার দাবি নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার কারিগর হওয়ার বড়াই করবেন কেন? আর যদি না জানেন তাদের মনের কথা, তা হলে আপনার মন যা চাইছে সেটা অন্তত করবেন না। সে তো আপনাকে জানাতে আসবে না, ভয়েই কুঁকড়ে থাকবে। আপনি কি শাস্তি দেওয়ার সময় জানতে পারবেন যে আপনার অপমানে তার মনটা এমন ঘষে গেল, যে সেই ঘষটানি সোজা মেরুদণ্ডে গিয়ে আক্রমণ করল, মেরুদণ্ড নুইয়ে গিয়ে তার মন আর মস্তিষ্ককে বুঝিয়ে দিল— আর কোনও দিন ভুলেও কোনও ভুল করো না, ভুলেও কলার তুলো না, ভুলেও নিজেকে মূল্যবান ভেবো না।
অতএব, তার মন আপনার মোক্ষম ‘শাস্তি’ সইতে পারবে কি না, তা না জেনে, কেবল আপনার মনের আরাম হবে বলে, তাকে অপমান করবেন না। এটা মানবিক বোধের বিরোধী। অন্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy