Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
Swami Vivekananda

ভাল রান্না না করতে পারলে ভাল সাধু হয় না, বলতেন স্বামীজী

ছেলেবেলায় বাবার বৈঠকখানায় সব গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে নরেন জাত যায় কী করে, পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২১ ০০:০১
Share: Save:

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হতে গেলাম, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অনেকেই দুঃখ পেয়েছিলেন। ছেলেটাকে বুঝি নিরামিষ খেয়েই কাটাতে হবে! কিন্তু হস্টেলে গিয়ে দেখলাম মাছ তো বটেই, ডিম আর মাংসও চলে। দু’বেলাই আমিষ। সে যুগে (১৯৬৯ সাল) মুরগির মাংস জুটত কালেভদ্রে। তখন মাংস মানেই পাঁঠা বা খাসি। সপ্তাহে একদিন মাত্র নিরামিষ। রবিবার। সেদিন বিকেলে অভিভাবকেরা আসবেন। সঙ্গে খাবারটাবার আনবেন। তাই পেটকে খানিকটা বিশ্রাম দেওয়া।

সন্ন্যাসীরাও আমাদের মতোই খাবার খেতেন। নরেন্দ্রপুরে যাওয়ার আগে সন্ন্যাসী সম্পর্কে অন্য রকম ধারণা জন্মেছিল। ভিক্ষা করে যা পান, সেটাই ফুটিয়ে খান। রাতের বেলাটা না খেয়েই কাটে। মাছ-মাংস নৈব নৈব চ। আমার ঠাকুরদা পূর্ণেন্দুমোহন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে ভাগবত পাঠ করতেন। ক্লাস ফোর- ফাইভে বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে ভারত সেবাশ্রমে গিয়েছি। তবে খাওয়ার সময় কখনও যাইনি। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার আগে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না। রবিবার-রবিবার যে সব আত্মীয় বাবা-মায়ের সঙ্গে আসতেন, তাঁদের অনেকেই মহারাজেরা ঘোরতর আমিষাশী শুনে হতাশ হতেন।

একদিন এক প্রবীণ সন্ন্যাসীকে প্রশ্ন করেই ফেললাম, তাঁরা মাছ-মাংস খান কেন। অন্য সন্ন্যাসীরা তো খান না। প্রবীণ সন্ন্যাসী মৃদু হেসে পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘‘স্বামীজী নিজে খেতে ভালোবাসতেন। অন্যদের খাওয়াতেও ভালোবাসতেন। আর যাঁরা অতি ভাগ্যবান, তাঁদের রান্না করে খাইয়েছেন। তিনি মাছ-মাংসের ভক্ত ছিলেন। তাঁর হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠানে খাওয়া নিয়ে বাছবিচার না থাকাই তো স্বাভাবিক।’’ তার পর হাসতে হাসতে বললেন, "ভাগ্যিস স্বামীজী এই নিয়ম চালু করেছিলেন! না হলে আমাদের কি হত বল তো?’’ পরে পড়েছি, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্যদের দীক্ষাদান কালে বলতেন, ‘‘আজ হতে তোকে ছত্রিশ জাতের অন্ন খাওয়ার অধিকার দেওয়া হল।’’

আরও পড়ুন: তোমার রক্ত, তোমার ভাই

খাওয়াদাওয়ায় যে জাতপাতের ভাগাভাগি, তা ভেঙে দেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। ছেলেবেলায় বাবার বৈঠকখানায় সব গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে নরেন জাত যায় কী করে, পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। বাবা বিশ্বনাথ দত্তের রসুইখানায় মুসলমান বাবুর্চি ছিল। শৈশব থেকেই নরেন্দ্রনাথ অতিশয় মাংসাশী। শ্রীরামকৃষ্ণও জানতেন, তাঁর প্রিয় শিষ্যের খাদ্যতালিকা থেকে মুরগি-পাঁঠা-মাছ-পোলাও কিচ্ছু বাদ যায় না। অথচ তিনি নিজে ছিলেন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। কট্টর নিরামিষাশী। মায়ের আমিষ ভোগ তিনি গ্রহণ করলেও খেতেন না। কপালে ঠেকিয়ে নামিয়ে রাখতেন। কিন্তু রবিবার তিনি মায়ের আমিষ ভোগও পুরোপুরি বর্জন করতেন। কপালে ঠেকানোর জন্যও গ্রহণ করতেন না। নরেন্দ্রর নির্দেশে তাঁর গুরুভাইয়েরাও সেটাই মানতেন। রামকৃষ্ণ মিশনেও সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সব শাখাতেই রবিবার তাই নিরামিষ আহার।

খাওয়াদাওয়ায় যে জাতপাতের ভাগাভাগি, তা ভেঙে দেওয়াই স্বামী বিবেকানন্দর উদ্দেশ্য ছিল। —ফাইল চিত্র।

পূর্বাশ্রম বা সন্ন্যাসাশ্রমে উপবাস-অনাহারে শরীর ক্ষয় করাকে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতেন না বিবেকানন্দ। মনে করতেন, সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়তে হলে সবল শরীর চাই। সেই শরীর রাখতে নিয়মিত আমিষ আহার এবং শরীরচর্চার প্রয়োজন। মঠ স্থাপিত হওয়ার পর অনেক সমালোচনা উপক্ষা করেও ওই দু’টি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন স্বামীজী। তাঁর নিজের পছন্দ ছিল প্রবল ঝাল। অনেক সময় নিজেই হাতা-খুন্তি ধরতেন। গুরুভাইরা তখন রান্না করতেন, তখন সকলে ভয়ে ভয়ে থাকতেন। ঋষিকেশের ঘটনা তাঁদের মনে ছিল। গুরুভাইরা মিলে ঝুপড়ি বেঁধে ঘোর তপস্যা করছেন। তার মধ্যে নরেন জ্বরে পড়লেন। মুখে কিছু রোচে না। তবু ইচ্ছে হল খিচুড়ি খাওয়ার। চাল-ডাল ভিক্ষা করে খিচুড়ি বসানো হল। আচ্ছা করে লঙ্কা দেওয়া হল। ভিক্ষায় খানিকটা মিছরি পাওয়া গিয়েছিল। রাখাল মহারাজ ছেলেমানুষ। ভাবলেন, এটা আর পড়ে থাকে কেন। খিচুড়িতে দিয়ে বসলেন। ব্যস, মিষ্টি খিচুড়ি মুখে তুলতেই নরেনের নাক সিঁটকে গেল! জ্বর গায়েই রাখালকে আচ্ছা করে বকে দিলেন, ‘‘খিচুড়িতে কখনও মিছরি দেয় রে? তোর একটু আক্কেল নেই!’’

আরও পড়ুন: ‘মরণোন্মুখ’ বাঙালিকে শিল্প ও বাণিজ্যমুখী করতে পরিবর্তন চাই

স্বামীজী তখন মেরঠে। এক আমির সাহেব তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা শুনে দেখা করতে এলেন। ইসলাম শাস্ত্রে নরেনের অসাধারণ পণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে তিনি মুগ্ধ। বাড়ি ফিরে তিনি কিছু সিধে পাঠিয়ে দিলেন। নরেন তা-ই দিয়ে নিজের হাতে মাংস-পোলাও রান্না করলেন। দারুণ সুস্বাদু। সেখানেই তাঁর হাতে আজন্ম নিরামিষভোজী হরি মহারাজের আমিষে অভিষেক হল। এমন রান্না নরেন্দ্রনাথ শিখলেন কোথায়? গুরুভাইদের তিনি বলেছিলেন সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে বাবুর্চিদের মাংস-পোলাও রান্নার কথা। কলেজে পড়ার সময়ে বিদেশি রান্না শেখার জন্য কিনেছিলেন ফরাসি রান্নার বই। সেই রেসিপি পড়ে বাড়িতে টুকটাক অভ্যাসও করেছেন। রান্না করাটা ছিল তাঁর হবি। পরবর্তী সময়ে স্বামীজী চেয়েছিলেন, তাঁর সব গুরুভাই যেন রান্না করতে পারেন। সকলে যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন। যাঁরা রাঁধতে পারতেন না, তাঁদের নিজের হাতে রান্না শেখাতেন। আমেরিকার দক্ষিণ পাসাডেনার ৩০৯ নম্বর মন্টেরি রোডে মিড বোনদের বাড়িতে থাকার সময় শেষ বিকেলে নৈশভোজ তৈরি করার ব্যাপারে কখনও সখনও মিসেস ওয়াইকফকে সাহায্য করতেন স্বামীজী। প্রায়শই নিজে সবক’টি পদ রান্না করতেন। রুটি-তরকারি এবং অন্য খাবারও তৈরি করতেন স্বামীজী। আবার লিঙ্কন পার্কে মিসেস হ্যান্সব্রোর বাড়িতে থাকার সময় সুযোগ পেলে রান্না করতেন। মিসেস হ্যান্সব্রো লিখেছেন, ‘‘লিঙ্কন পার্কে আমাদের বাড়িতে থাকার সময় তিনি নিজেই সকলের জন্যে পুরো রান্না সেরে ফেলতেন। তরকারি ও চাপাটি তৈরি করতেন। যা সকলের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। যেসব মশলাপাতি দিয়ে রান্না করতেন, তার অধিকাংশই বাটতে হত (গুঁড়ো করতে হত)। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করা পছন্দ করতেন না। তাই একটি মাখন রাখার বাটি সামনে রেখে আসনপিঁড়ি করে রান্নাঘরের মেঝেয় বসে পড়তেন।’’

একই জিনিসের বিদেশি এবং স্বদেশি, দুই রান্নাতেই যে স্বামীজীর সমান দক্ষতা ছিল, তার প্রমাণও পেয়েছেন তাঁর গুরুভাইরা। —ফাইল চিত্র।

মশলা গুঁড়ো করে নেওয়ার পর সেগুলো দিয়ে তরকারি সাঁতলানোর জন্য উনুনের কাছে যেতেন। সাঁতলানো মশলার ধোঁয়ায় চোখ জ্বলত। ব্রহ্মচারিণী ঊষা ‘বেদান্ত অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছেন, ‘‘স্বামীজী সকলকে সাবধান করার জন্য আগে থেকেই উঁচুগলায় ঘোষণা করতে করতে আসতেন, ওই ঠাকুরদাদা আসছেন। মহিলাদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। যাতে মশলার ঝাঁজ অন্য কাউকে পোয়াতে না হয়।’’ মিসেস হ্যান্সব্রোর লেখায় রয়েছে, রান্না করার সময়ে স্বামীজীর মন আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠত। মিসেস হ্যান্সব্রো লিখেছেন, স্বামীজী খুব একটা হাসতেন না বা ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন না। সবচেয়ে হাসিখুশি মেজাজে থাকতেন, যখন তিনি রান্নাঘরে স্বাধীন ভাবে ছোটাছুটি করে পুরো পরিবারের জন্য হরেক পদের রান্না করার অনুমতি পেতেন। কিন্তু স্বামীজীর হালকা মেজাজের সময়েও তাঁর সান্নিধ্যে থাকতে পারলে বহু শিক্ষা পাওয়া যেত। তিনি কখনও মৌখিক নীতি-উপদেশ দিতেন না। শুধুমাত্র চোখ খুলে দিতেন।

একই জিনিসের বিদেশি এবং স্বদেশি— দুই রান্নাতেই যে স্বামীজীর সমান দক্ষতা ছিল, তার প্রমাণও পেয়েছেন তাঁর গুরুভাইরা। একবার স্বামীজীর শরীর খুব খারাপ। ছ’সাতদিন ধরে শুধু দুধ খেয়ে আছেন। এক ভক্ত সে সব না জেনেই একটি রুই মাছ নিয়ে এলেন। সেদিন ছিল রবিবার। মঠে নিরামিষ। খবর গেল স্বামীজীর কাছে। তিনি মাছ দেখে খুব খুশি। রবিবার বলে সেদিন ওই মাছ ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া যাবে না বলে কথা উঠল। স্বামীজী বললেন, ‘‘ভক্তের আনা জিনিসে শনিবার-রবিবার নেই। ভোগ লিগে যা।’’ মাছ কাটার পরে কিছুটা ঠাকুরের ভোগের জন্য রেখে বাকিটা নিজে বিলিতি পদ্ধতিতে রাঁধবেন বলে রেখে দিলেন স্বামীজী। দুধ-দই দিয়ে চার-পাঁচ রকমের পদ রান্নাও করে ফেললেন। দুধ দিয়ে যে পদটি রান্না করলেন, তার পোশাকি নাম ফিশ ইন হোয়াইট সস। সসপ্যানে ময়দা আর মাখন বেশ ভাল করে নাড়ার পর বাদামি রঙ ধরে গেলে একটু একটু করে দুধ মেশাতে হয়। খুব ধৈর্যের প্রয়োজন। স্বামীজী সেটি তৈরি করলেন। সঙ্গে তৈরি করলেন দই-মাছ।

সাধে কি স্বামীজী বলতেন, ‘‘যে ভাল রাঁধতে পারে না, সে ভাল সাধু হতে পারে না। কারণ, মন শুদ্ধ না হলে রান্না সুস্বাদু হয় না!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy