আপাতত যা বোঝা যাচ্ছে, করোনায় ক্ষয়-ক্ষতি অনেক হবে, গরিবরা সব দিক থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন (সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়), চাকরি যাবে, ব্যবসা নষ্ট হবে। তবে মনে হচ্ছে এ যাত্রায় মানবপ্রজাতি বিনষ্ট হয়ে যাবে না। প্রতিষেধক তাড়াতাড়ি বেরোলে ভাল, তা না হলেও আস্তে আস্তে অন্তত উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা আবার নানা ভাবে জীবনে ফিরবে। কাজেই কোভিড-১৯’পরবর্তী জীবনটা কেমন হবে, তা নিয়ে একটু আলোচনা করাটা সময় নষ্ট হয়তো নয়।
কোভিড-১৯’এর ঠিক আগে আমরা নাগরিকত্ব নিয়ে নানান তর্কের মধ্যে ছিলাম। আইন তৈরি করে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষদের সব ভাবে বিপন্ন করা, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলা ইত্যাদির চেষ্টা এবং তার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন ইত্যাদি চলছিল। এ কথা মনে করার কোনও কারণ দেখছি না যে অতিমারির প্রকোপ কমলে আমরা যে বাস্তবে ফিরব তাতে সেই অবস্থার খুব কোনও বদল ঘটবে। ‘ওরা থুতু মাখাচ্ছে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য, ওদের থেকে আনাজ কিনো না’, ইত্যাদি যে সব কথা আমরা কিছু রাজনৈতিক নেতার মুখে শুনছি, তাতে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলবে বলেই মনে হয়।
তাই কোভিড-১৯ থেকে যখন আমরা ফেরত যাব, তখন ‘অতিমারির সময় এমন কি কিছু ঘটল যা আমাদের পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে’— এই প্রশ্নটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। একটা নয়, অনেক কিছুই ঘটেছে, ঘটছে— তার একটা বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। খ্যাতনামা সমাজতত্ববিদ ইউভাল নোয়া হারারি কোভিড-১৯’পরবর্তী দুনিয়া নিয়ে তাঁর এক সাম্প্রতিক লেখায় বলছেন, যে কোনও সঙ্কট ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াগুলোকে দ্রুততর করে দেয়। ফলে একটা নতুন বাস্তবে দাঁড়িয়ে চটপট আমাদের নতুন কিছু ‘চয়েস’ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে উনি ‘সর্বগ্রাসী নজরদারি’ আর ‘নাগরিক ক্ষমতায়নের’ মধ্যে বেছে নেওয়ার কথা বলছেন।
কোভিড-১৯ আমাদের রাষ্ট্রগুলোর হাতে নজরদারির অপরিমিত ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে। সাধারণত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, এ বার সেগুলো সাধারণ নাগরিকদের ওপরে ব্যবহার করা হচ্ছে, রোগ নির্ণয়ের জন্য। এই নজরদারির প্রযুক্তির ওপর এখন আরও জোর দেওয়া হচ্ছে বলে খুব দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে আর করোনাভাইরাসের মতো রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এর সামাজিক প্রয়োগ আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। হারারি বলছেন, অতিমারি-পরবর্তী সময়েও এই ধরনের প্রযুক্তি নাগরিকদের ওপর ব্যবহার করা চলতে থাকবে। এর পর একেবারে নতুন দিক যেটা হবে সেটা হল, নজরদারি আর কেবল শরীরের বাইরে থেকে হবে না, হবে একবারে চামড়া ফুঁড়ে। এত দিন আমাদের আঙুল স্মার্টফোনে চাপ দিলে, কোনও লিঙ্ক ক্লিক করলে তবেই কোনও সরকার জানতে পারত, আমরা কিসে জড়াচ্ছি। কিন্তু করোনাভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে ফোকাসটা আরও গভীরে চলে যাচ্ছে। সরকার জানতে চায়, নাগরিকের আঙুলের তাপমাত্রা কত? তার শরীরের রক্তচাপের মাত্রা কী? এমন সময় আসতেই পারে যখন আমাদের সবাইকে একটা বালা পরে ঘুরতে হবে, যা দিয়ে কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি কম্পিউটার জানতে পারবে দেশের যে কোনও নাগরিকের শরীরের তাপমান কখন বাড়ে-কমে, রক্তচাপ আর হৃদস্পন্দন কেন, কিসে বদলায়! তার মানে আপনি সুস্থ কি না, সেটা আপনি জানার আগেই সরকার জেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে পারবে। বা হয়তো সরকারি রোগনির্ণয় অনুযায়ীই আপনাকে অসুস্থ ঘোষণা করা যাবে। আর আমরা কোথায় যাই, কার সঙ্গে দেখা করি, ফোনে কী বলি, সেগুলো তো আগেই জানা। তার ফলে সরকারের কাছে যে কোনও নাগরিকের কেবল বাইরের গতিবিধি নয়, অভ্যন্তরীন অবস্থার সাবুদও থাকবে।
মনে হতেই পারে, এ তো খুবই ভাল। এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কী আছে? কিন্তু গল্পটা কি অতই সহজ? আমাদের দেশে, দুনিয়ায় অসুখ কি কেবল ‘ভাইরাস’ থেকে হচ্ছে? না কি, ‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন’— যার প্রতিষেধক আমরা এখনও বার করতে পারিনি? এমনকি কোভিড-১৯’এর মুখে দাঁড়িয়েও অসাম্যের রোগ, সাম্প্রদায়িকতার রোগ থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছে কি? না কি, সেই সব রোগের কারণেও অনেক মৃত্যু, অনেক কষ্ট (এমনকি হয়তো বেশিও) ঘটে চলেছে, চলবে বলেই মনে হয়? আজকেও কোটি কোটি পরিযায়ী এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ, ছোট কারবারিদের জীবনে মূল ভয় কোভিড-১৯, না অনাহার? যার মধ্যে আবার ধর্মীয় অবিচার, অত্যাচারও সামিল?
দেশ-জোড়া এত বড় বিপদেও রাজনীতি, ধর্ম, শ্রেণি বা বর্ণ অনুযায়ী পক্ষপাতিত্ব কমেছে কি? বরং বেড়েছে। বিরোধিতা নিয়ে অসহিষ্ণুতা আমাদের দেশে এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে যে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল, ভাইরাসের প্রকোপ কমলেই সেটাও কমবে বলে তো মনে হয় না।
তা হলে একটা সম্ভাব্য পরিস্থিতি কল্পনা করুন। যখন রাষ্ট্র যাকে আদর্শগত বা ধর্মীয় ‘সংক্রমণ’ বলে মনে করবে, তাকে চিহ্নিত করার কাজে কোভিড-১৯’এর সময়ে ব্যবহৃত নজরদারি প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারবে। তখন কিন্তু আপনি মন্দির-মসজিদ-গির্জার কোনটায় গেলেন, বা কোন জঙ্গলমহলে গেলেন বা কার সঙ্গে দেখা করলেন, কী ই-মেল করলেন বা ফেসবুকে কী লিখলেন, শুধু সেটুকুই নয়, কোনও একটি নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস রক্তচাপ বাড়ায় বলে কিছু গোষ্ঠীর মানুষকে হয়তো কোয়রান্টিন করা যাবে। এমনকি কোন ক্রিকেট টিম জিতলে হৃদস্পন্দন বাড়ে/কমে, সেটা মেপেই ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘দেশপ্রেমিক’ বলে চিহ্নিত করার ‘বৈজ্ঞানিক’ পরীক্ষা গণ হারে চালানো যাবে। আরও অনেক কিছু হতে পারে যা এখনও জানি না। অষ্টমীতে আমিষ খাওয়াও কিন্তু বাঙালির রক্তচাপ বাড়াতে পারে!
হারারির দুশ্চিন্তা বাড়াবাড়ি? এমনটা হতে পারে না? হয়তো তাই। এ সব না হলেই ভাল। কিন্তু গত কয়েক বছরে এমন অনেক কিছুই আমরা দেখলাম, যেগুলো ঘটতে পারে এ কথা আগে কেউ বললে আমরা বলতাম: ‘যাহ, এটা হতেই পারে না’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy