সুভাষচন্দ্র বসু।
নদিয়ার বরেণ্য সন্তান স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমন্তকুমার সরকার ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সেই সূত্রেই সুভাষচন্দ্র বসুর কৃষ্ণনগরে যাতায়াত ছিল।
কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হেমন্তকুমার সরকার কিংবদন্তি শিক্ষক বেণীমাধব দাসকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরে বদলি হয়ে আসার আগে বেণীমাধব দাস ছিলেন কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং সেখানে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র। ১৯১২ সালে পুজোর ছুটিতে পুরী যাওয়ায় পথে হেমন্তকুমার কটকে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেখা করেন বেণীমাধব দাসের ইচ্ছা অনুসারে। এটি বেণীমাধব দাসের একটি সত্যিকারের স্মরণীয় কীর্তি, এই সুভাষচন্দ্র-হেমন্তকুমার সরকারের মধ্যে সংযোগ সাধন।
সুভাষচন্দ্র বসু ছোটবেলা থেকেই সেবাব্রতী ছিলেন। হেমন্তকুমারের সংস্পর্শে এসে তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলেন। স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর ‘ভারত পথিক’ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে, কিশোর বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারের সান্নিধ্যে এসেই তাঁর রাজনীতি চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই পর্বের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ হেমন্তকুমার সরকারের ‘সুভাষের সঙ্গে বারো বছর’ গ্রন্থে পাওয়া যায়।
সময়টা ১৯১৩ সাল। এই সময়েই হেমন্ত সরকার কলকাতার প্রতিভাবান ছাত্রদের একটি দলের সদস্য হয়েছিলেন এবং পরে সুভাষচন্দ্রকেও তিনি এই দলে নিয়ে আসেন। ১৯১৩ সালের মে মাসে হেমন্তের আহ্বানে সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম কৃষ্ণনগরে আসেন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর। এ সময়ে কলকাতার ছাত্রদলটিও এসে জুটলেন এবং সকলে মিলে নদীপথে পলাশি, বহরমপুরের ঐতিহাসিক স্থানগুলি পরিভ্রমণ করেন। এই দলে সুভাষ, হেমন্তকুমার ছাড়াও ছিলেন যুগলকিশোর আঢ্য, সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুদাস গুপ্ত, অমূল্য উকিল প্রমুখ। এঁরা প্রথমে যান পলাশি, পরে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। বহরমপুর থেকে নৌকায় ফেরার সময় রাত হয়ে যায়। রাতটা ছিল জ্যোৎস্নার রাত। সকলে মিলে সুভাষচন্দ্রকে একটি গান গাইতে বলায় ওই রাতে নৌকায় বসে সুভাষচন্দ্র গেয়েছিলেন, ‘‘দূরে হের চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত গঙ্গা/ধায় মত্ত হরষে সাগরে–পদ পদ পরশে/কূলে কূলে বারি পরিবেশন মঙ্গলময়ী বরষা/শ্যামধরণী সরসা।’’
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে বসে না থেকে হেমন্তকুমার সরকার তাঁদের বাড়ির কাছে একটি ঘরে শ্রমজীবীদের জন্য অবৈতনিক নৈশবিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সুভাষচন্দ্র বসু মাঝে মাঝে এই বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষকতা করতেন। তখন নদিয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার এস সি মুখোপাধ্যায়, আই সি এস, এই মহানুভব রাজকর্মচারী এই বিদ্যালয়টিকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। গভর্নমেন্ট ও মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নিয়মিত সাহায্যের বন্দোবস্ত হয়। অনেক সুবিখ্যাত মানুষ এই স্কুল পরিদর্শন করেছেন এবং নানা ভাবে স্কুলটিকে সাহায্য করেছিলেন। পরে তিন জন বেতনভোগী শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়।
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় (১৯১৩) সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ় পড়ার জন্য ভর্তি হন। হেমন্তকুমার সুভাষচন্দ্রের মতোই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কোনও দিন স্কুলের পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় হননি। সুতরাং, সকলেই আশা করেছিলেন সেই বছরের (১৯১৩) ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় সুভাষ ও হেমন্তের মধ্যে এক জন প্রথম এবং অন্য জন দ্বিতীয় হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সকলের এই আশা বাস্তবায়িত হয়নি। এই বিষয়ে হেমন্তকুমার অনেক জায়গাতেই দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন, ‘‘সুভাষের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার আর পড়াশোনায় মন বসত না। কয়েকটি বিষয়ে ফুল মার্কস পেলেও ইংরাজি প্রথম পেপারে কী একটা গোলযোগ হওয়ায় আমার স্থান ৩৫ জনের নীচে হয়ে গেল।’’ হেমন্তকুমার কৃষ্ণনগরে থেকে সরকারি কলেজে আই এ পড়া শুরু করেন।
মাঝে মাঝেই ছুটির দিনে কৃষ্ণনগরে আসতেন সুভাষচন্দ্র। এখানে অঞ্জনার ধারে এই দুই উজ্জ্বল ছাত্রের বৈঠক বসত। কৃষ্ণনগর শহরের যেখানে বর্তমানে গেটরোড শ্মশান কালীবাড়ি, তার পাশেই অঞ্জনার খাল। জলঙ্গি নদী থেকেই উৎপত্তি এই অঞ্জনা খালের। ধূলিমলিন এই পৃথিবীর অনেক ঊর্ধ্বে, মহাপুরুষদের সমগোত্রীয় দু’জন মানুষ অঞ্জনার খালপাড়ের এই নির্জন প্রান্তরে বসে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্নে বিভোর থাকতেন।
কিছু দিন পর ইন্দ্রদাস বাবাজি নামে এক উদাসী পাঞ্জাবী সাধু জলঙ্গির তীরে আস্তানা করলেন। হেমন্তকুমার ও সুভাষচন্দ্র এই সাধুর খুবই ভক্ত হয়ে পড়লেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এই সাধু কিন্তু এক দিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। তার পরই এল সন্ন্যাস গ্রহণের প্রস্তুতিপর্ব। আধ্যাত্মজীবন, ব্রহ্মচর্য এবং সন্ন্যাস জীবনের প্রতি একটি দুর্বার আকর্ষণ সুভাষচন্দ্র ও হেমন্তকুমার উভয়ের মধ্যেই কিশোরবেলা থেকেই লক্ষ করা যেত। হেমন্তকুমার সরকার তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন, ‘‘ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসী হলাম। গেরুয়া পরা অবস্থায় কিছুদিন ছিলাম শান্তিপুরে ভরত পোদ্দারের গঙ্গার ধারের খালি বাড়িতে। আমার সহযোগী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী, গয়া প্রভৃতি জায়গায় সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরেছিলাম সদগুরুর সন্ধানে। গ্রীষ্মের দুপুরে কুঁজো বগলে, বিনা ছাতায় ৬ মাইল পথ হেঁটে চললাম বুদ্ধ গয়ায়। সেখানে মোহন্ত মহারাজের অতিথি হওয়া গেল। কী রাজসিক আড়ম্বর! গাড়ি, ঘোড়া, হাতী, লোকজন, প্রাসাদ-স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্র ও সিদ্ধি ঘোঁটার কী জাঁকজমক! এইসব দেখেশুনে সন্ন্যাসের ওপর মন চটে গেল। বাড়ি ফেরাই সাব্যস্ত করলাম। সারা ভারত ভ্রমণ করে গুরু লাভ হল না। কাশীতে থাকার সময়ে স্বামী ব্রহ্মনন্দ উপদেশ দিলেন বাড়ি ফিরতে, কারণ আমাদের মন তখনও সন্ন্যাসের জন্য তৈরি হয়নি।’’
হেমন্তকুমার সরকারের সঙ্গে ১৯১২ সালে কটকে সুভাষচন্দ্রের দেখা হওয়ার পর থেকে তাঁদের দুই বন্ধুর জীবনের স্রোতধারা একসঙ্গে মিশে যায়। তার পর সুভাষচন্দ্রের আইসিএস ছেড়ে ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে যাওয়া পর্যন্ত একই ধারায় চলে তাঁদের জীবন।
(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)
কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy