Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Student

পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান

শাসকের চোখরাঙানির কবেই বা তোয়াক্কা করেছে ছাত্রশক্তি। শাসনের বাঁধন যতই শক্ত হয়েছে, ততই প্রবল হয়েছে স্বাধীনতার ইচ্ছা। মুক্তির আকাশে ডানা ঝাপটে উড়তে চেয়েছে ছাত্রসমাজ। লিখলেন সায়ন্তন দাসযুগে যুগে দেশে দেশে একনায়কতন্ত্রী শাসন যখনই মাথাচাড়া দিয়েছে, তাকে চেষ্টা করতে হয়েছে স্বাধীন চিন্তার উৎসস্থলগুলিকে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণের।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:০৯
Share: Save:

এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে— এটা শুধু হীরক রাজার স্বগোতক্তি না। যুগে যুগে দেশে দেশে একনায়কতন্ত্রী শাসন যখনই মাথাচাড়া দিয়েছে, তাকে চেষ্টা করতে হয়েছে স্বাধীন চিন্তার উৎসস্থলগুলিকে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণের। একনায়কতন্ত্রের লক্ষ হয়ে উঠেছে তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। বিরুদ্ধমতকে যদি সমূলে উচ্ছেদ করতে হয় তবে প্রয়োজন হয় মগজে কারফিউ জারি করার। তাই দেখা গিয়েছে, যখনই স্বৈরাচার মাথা তুলেছে, যখনই কোনও একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিস্ট বা নাৎসি-শাসন গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস নিয়েছে।

কিন্তু শাসকের চোখরাঙানিকে কবেই বা তোয়াক্কা করেছে ছাত্রশক্তি। শাসনের বাঁধন যতই শক্ত হয়েছে, ততই প্রবল হয়েছে স্বাধীনতার ইচ্ছা। শিক্ষা থেকে চেতনা, চেতনা থেকে মুক্তি। আর সেই মুক্তির আকাশে ডানা ঝাপটে উড়তে চেয়েছে ছাত্রসমাজ। সে জন্যই বারবার শাসকের চোখে চোখ রেখে তারা বলতে পেরেছে নিজেদের প্রতিবাদের ভাষা। সাহস করে দেখিয়ে দিতে পেরেছে শাসকের কদর্য রূপ, অবলীলায় প্রশ্ন তুলেছে— ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’

হাবসবুরগ সাম্রাজ্যের চ্যান্সেলর মেটারনিক থেকে শুরু করে আমাদের দেশে লর্ড কার্জন, জার্মানিতে হিটলার, ইটালিতে মুসোলিনি প্রত্যেকেরই চেষ্টা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কণ্ঠরোধ করা। এই জন্য নানান বিধিনিষেধ, কার্লসবার্ড ডিক্রি মতন কালা আইন তারা একের পর এক জারি করেছেন। অথচ, এই ছাত্ররাই বিপ্লবের যে আগুন ধরিয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত একনায়কতন্ত্রের যাবতীয় বাধা দূর হয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। আজ যখন দেখছি, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন দেশের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বারবার হিংসার দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে, ইতিহাসের পিছনে ফেলে আসা সেই অধ্যায়গুলো যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে।

শুরুতেই বলি মেটারনিকের কথা। ১৮১৫-র পর থেকে ৪৮ পর্যন্ত ইউরোপের রাজনীতিতে তার দাপট ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীনতা দাবি করা যায় না। তা আসে কর্তৃত্বের কাছ থেকে। কঠোর সেন্সর প্রথা চালু করে তিনি স্বাধীন চিন্তাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর নিয়ন্ত্রণে এনে যাবতীয় রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা বন্ধ করেছিলেন। এমনকি, ইতিহাসের পাঠক্রমে পর্যন্ত বদল এনেছিলেন। তাৎক্ষণিক সাফল্য মেটারনিখ পেলেও খেপে উঠেছিল জার্মানির ছাত্ররা। ১৮৪৮-এর বিপ্লবের আগুন শুধু মেটারনিকের রক্ষণশীল ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেনি, মেটারনিক বাধ্য হয়েছিলেন অস্ট্রিয়া ছেড়ে ইংল্যান্ডে পলায়ন করতে। তার পর ইতিহাস আর তার খোঁজ রাখেনি।

১৯৪২-এর জার্মানি নাৎসি শাসনের উত্তুঙ্গ পর্যায়। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তখনই শ্বেত গোলাপ গোষ্ঠী তৈরি করে শুরু করে নাৎসিবিরোধী এক অহিংস আন্দোলন। সেই বিদ্রোহে উদয়ন পণ্ডিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের দর্শনের অধ্যাপক কার্ট হুবের। উইলি গ্রাফ, এলেক্স স্কমুরেল, সফিয়ে স্কোলরা লিখেছেন নাৎসিবিরোধী পুস্তিকা। তাঁরা পেরেছিলেন নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিনের দাপট কমাতে।

১৯৬০-এর দশকের একদম শেষের দিকে আমেরিকা যখন ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, তখন খোদ আমেরিকারই কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা শুরু করেছিল যুদ্ধবিরোধী তীব্র আন্দোলন। তারা গড়ে তুলেছিলেন স্টুডেন্ট ফর আ ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটি নামে এক সংগঠন। যুদ্ধ যত এগিয়েছে, তত এদের কণ্ঠ তীব্র হতে থাকে। এই বিক্ষোভ থামাতে মার্কিন সরকারকে গুলি চালাতে হয়। মারা যান বহু ছাত্র। বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। ১৯৭৩-এ নিক্সন যে সেনা প্রত্যাহার করলেন ভিয়েতনাম থেকে, তার পিছনে প্রধানত ছিল এই কেনটের ছাত্র আন্দোলন।

১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় সোয়েটো হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অ্যপারথেড এবং বান্টু শিক্ষা আইনের (যা কালো মানুষদের শিক্ষার অধিকারকে খুবই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল) বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পুলিশ তাঁদের উপর গুলি চালালে এই আন্দোলন সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছাত্র আন্দোলন গোটা বিশ্বকে উথালপাথাল করে দিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার দিনবদলের সময় এসেছিল। এই তো সে দিন হাতের কাছেই বাংলাদেশের ছাত্রেরা স্পর্ধা দেখিয়েছিল রাষ্ট্রের সংস্কার আন্দোলনের।

আমাদের দেশেও তো ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের কোনও অভাব নেই। স্বাধীনতা আন্দোলন কালে স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে একের পর এক গাঁধীবাদী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ছাত্রদের গৌরবময় ভূমিকা থেকেছে। এমনকি, কুখ্যাত ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময়েও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বুঝিয়ে দিয়েছে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি কত গভীর। কোনও অভিসন্ধি তা ভঙ্গুর করে দিতে পারবে না।

ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’— এই স্লোগানে মাতিয়ে দিয়েছিল সারা বাংলা। পরবর্তী কালে নানান রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলন ঘটেছে। সেই সব ছাত্র আন্দোলনে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গৌরবময় নেতৃত্বে রয়েছে।

তাই যখন দেখি ছাঁচে ডেলে দেওয়া, সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রতিবাদ করছেন ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার, যখন দেখি শাসকের বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করছেন ছাত্রছাত্রীরা, যখন দেখি দেওয়ালে-দেওয়ালে স্লোগানে-স্লোগানে মিছিলে-মিছিলে গানে-গানে একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতায় মুখরিত হচ্ছে দেশ, আর তা করতে গিয়ে ঐশীর মতো মেয়েরা রক্তাক্ত হচ্ছে— তখন মনে হয় কবীর সুমন কি এ জন্যই বলেছিলেন— কার তাতে কি আমরা যদি এই অকালেও স্বপ্ন দেখি?

স্বপ্ন দেখা জারি থাকুক।

শিবপুর দীনবন্ধু কলেজের ইতিহাস শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Student Student Power CAA NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy