সেই স্মারক। ফাইল ছবি
১৮৯৭-এর অগস্ট। সেকেন্দ্রাবাদের বেগমপেট-এর হাসপাতালে গত দু’বছর ধরে এক ইংরেজ চিকিৎসক-বিজ্ঞানী নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে বেশিরভাগ সময় কেটে যায় তাঁর।
নাম রোনাল্ড রস। ম্যালেরিয়ার কারণটি যে ‘ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট’ নামের পরজীবী তা ১৮৮০ সালে ফরাসি বৈজ্ঞানিক আলফোনস ল্যাভেরান-এর আবিষ্কার থেকেই জানা গিয়েছিল। কিন্তু এই পরজীবী কী ভাবে মানুষে সংক্রামিত হচ্ছে তখন তা ছিল অন্ধকারে। এই নিয়েই গবেষণায় মগ্ন ছিলেন রোনাল্ড রস।
সেকেন্দ্রাবাদে অগস্টে দুঃসহ গুমোট গরম। মশা ব্যবচ্ছেদ করে মাইক্রোস্কোপের নীচে প্রধানত তার পাকস্থলীর কোষে ম্যালেরিয়া পরজীবির সন্ধান করে চলেছেন রস। তিনি জানান, প্রথমে কাজে অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু বার বার ব্যর্থতা পর্যুদস্ত করে ফেলছিল তাঁকে। হাসপাতালের ঘরটি ছোট, গরম আর অন্ধকার। ছাদের কার্নিসের নীচ দিয়ে কোনও মতে আলো আসছে। পাখা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ, তা হলে হাওয়া উড়িয়ে দেবে ব্যবচ্ছেদ করা মশাগুলিকে। আই ফ্লাই নামের ছোট ছোট মাছির ঝাঁক মহানন্দে রসের কানে, চোখের পাতায় এসে চরম জ্বালাতন করছে। কখনও কখনও দু’-একটা ‘স্টেগোমিয়া’ মশা কামড়ে তাদের বন্ধুদের মৃত্যুর জন্য রসের উপরে শোধ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। রসের কপাল ও হাতের ঘামে মরচে পড়ে গিয়েছে মাইক্রোস্কোপের স্ক্রুগুলি, তার শেষ অবশিষ্ট আই-পিসটিতেও ধরেছে চিড়।
মশার কামড়েই যে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে এটা বুঝতে পেরেও রোনাল্ড রস তা প্রমাণ করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কারণ, তার পরীক্ষিত মশাগুলি ম্যালেরিয়া বাহক প্রজাতির ছিল না। অবশেষে তিনি পেলেন বিশেষ ‘বিন্দুচিহ্নিত ডানাওয়ালা’ মশাকে। সহকারীদের সাহায্যে তাঁকে রক্ত পরীক্ষার জন্য বা মশার কামড় খাওয়ার জন্য লোক জোগাড় করতে হত। ১৬ অগস্ট ওই বিশেষ মশাকে তিনি ব্যবহার করলেন হুসেন খাঁ নামে ম্যালেরিয়ায় সংক্রমিত এক রোগীর উপরে। অন্য বার হুসেন খাঁ এক আনা পেলেও এ বার পেলেন দশ আনা। এর পরে ২০ অগস্ট-এর সকাল। এ দিন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিন হয়ে থাকবে। সকাল সাতটায় রোনাল্ড রস হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখলেন, তাঁর ডাকের চিঠিপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন, তার পরে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ শেষ করে শুরু করলেন তাঁর কাজ। দুপুর একটায় পেলেন তাঁর বহু দিনের সাধনার ফল। সংক্রমিত মশার পাকস্থলীর দেওয়ালে পেলেন ম্যালেরিয়া পরজীবী। তিনিই ঘোষণা করলেন এই ২০ অগস্ট হোক ‘বিশ্ব মশা দিবস’।
তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার এক মানুষ— চিত্রশিল্পী, গণিতবিদ, সুরকার, কবি, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। চিকিৎসক হওয়া কখনই লক্ষ্য ছিল না। বাবার চাপে তাঁর চিকিৎসক হওয়া। আর জীবনের ঘটনাচক্র তাঁকে নিয়ে গেল চিকিৎসা, গবেষণা ক্ষেত্রে। নিজের মেধা ও অধ্যবসার জোরে মোক্ষ অর্জন করলেন সেখানেই। প্রথম বার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস-এর পরীক্ষায় পাশ করতে ব্যর্থ হলেন। বাবার ভ্রূকুটিতে আবারও তাঁকে সেই পরীক্ষার প্রস্তুতিতে থাকতে হল। মাঝের সময়টুকু কাটিয়ে দিলেন এক নিউ ইয়র্ক-লন্ডন জলপথের জাহাজের সার্জেনের চাকরি নিয়ে। পরের বার ১৮৮১ সালে যোগ্যতা পরীক্ষায় পাশ হলেন। প্রথম পোস্টিং হল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে। তাঁর জীবনে ও মনে ম্যালেরিয়া বা মশার একটা জায়গা ছিল। ছোটবেলায় ভারতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখেছেন। তাঁর বাবাও আক্রান্ত হয়ে ছিলেন ম্যালেরিয়ায়।
মাদ্রাজে কাজ করার সময়ে তিনি বেশির ভাগ সময় নিজেকে নিযুক্ত রেখে ছিলেন কুইনাইন দিয়ে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায়। ১৮৮৩-এ বেঙ্গালুরুতে যে বাংলোটি পেলেন তাতে মশার উৎপাত প্রবল। কারণ, খুঁজতে গিয়ে দেখলেন জানলার পাশে বিশাল খোলা জলাধার। তাতে মশার লার্ভা দেখে বুঝলেন এটিই তাদের প্রজননস্থল। সেটি জলমুক্ত করতেই মশার উৎপাত কমে গেল। পরিষ্কার জমা জলকে ‘টার্গেট’ করে মশার প্রজননস্থলকে নির্মূল করার পদ্ধতির তিনিই হবেন পথপ্রদর্শক।
সাত বছর ভারতে থাকার পর রস ১৮৮৮ তে এলেন লন্ডনে। ইতিমধ্যে তাঁর লেখা হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটি উপন্যাস— ‘দ্য চাইল্ড অব দ্য ওসেন’, ‘স্পিরিট অফ দ্য স্টর্ম’, ‘দ্য রেভেলস অব ওসেরা’। বুঝতে পারছিলেন তাঁর সাহিত্য রচনার প্রয়াস সার্থকতার মুখ দেখছে না। তিনি পেশাগত দিকটিকেই আঁকড়ে ধরলেন। জনস্বাস্থ্যের উপরে ডিপ্লোমা কোর্স যেমন করলেন, তেমনই মাইক্রোস্কোপ ও ল্যাবরেটরিগত শিক্ষায় দীক্ষিত হলেন। কিন্তু তবুও ভারতে ফিরে কাজে তেমন সাফল্য পাচ্ছিলেন না। এর পরে তার জীবনে ঘটল সেই বিশেষ ঘটনা। ১৮৯৪-এ ছুটিতে লন্ডনে এসে পরিচত হলেন ফাইলেরিয়ার কারণ যে কিউলেক্স মশা তার আবিষ্কারক ও ট্রপিক্যাল ডিজিজ-এর স্থপতি প্যাট্রিক ম্যানসন-এর সঙ্গে। ম্যানসনই রস-এর কাজের অভিমুখ ঠিক করে দিলেন পথপ্রদর্শক ও শিক্ষাগুরুর মতো। মশা-ই যে ম্যালেরিয়ার বাহক এই দৃঢ় ধারণা তিনি রস-এর মধ্যে সঞ্চারিত করলেন। ১৮৯৫-এর মার্চে ভারতে ফিরে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করলেন কাজ। রসের হতাশা, বার বার ব্যর্থতায় ম্যানসন তাঁকে উদ্দীপনা জুগিয়েছেন, প্রেরণা ও সাহস দিয়েছেন। তাঁদের পরস্পরের মধ্যে ১৭৩টি চিঠির বিনিময় তার প্রমাণ। এরই ফসল ১৮৮৭-এর যুগান্তকারী আবিষ্কার।
রোনাল্ড রস উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে কখনও সহযোগিতা পাননি। গবেষণা, সহকারী নিয়োগ ইত্যাদির জন্য অর্থ ব্যয় তাঁকে নিজেকেই করতে হয়েছে। আর বারবার পেয়েছেন বদলি হয়ে যাবার নির্দেশ।
এমনকি, এই আবিষ্কারের কিছু দিন পরে তাঁকে বদলি হতে হল রাজস্থানের মরুভূমি লাগোয়া গ্রামে, সেখানে ম্যালেরিয়া এক বিরল অসুখ। সেখানে তিনি পাখির উপরে ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। অনেক চেষ্টায় অবশেষে তিনি ১৯৯৮-এর ২৯ জানুয়ারি কলকাতায় আসতে পারলেন। কলকাতার পিজি হাসপাতালে (এখনকার শেঠ সুখলাল করোনানি হাসপাতাল) শুরু হল তাঁর গবেষণা। তিনি পাখির উপরে গবেষণা করে দেখালেন যে মশার পাকস্থলীতে ম্যালেরিয়া পরজীবী বড় হয়ে জমা হচ্ছে মশার স্যালাইভারি গ্লান্ডে। তার পরে দংশনের সঙ্গে সংক্রামিত করছে সেই পরজীবী। তাঁর আবিষ্কারের জন্য ১৯০২ সালে পেলেন নোবেল পুরস্কার। তিনি শুধু ব্রিটেনেরই নন, কলকাতা তথা ভারতের প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপক। তাঁর ও তাঁর কাজের প্রতি সম্মানে পিজি হাসপাতালে এক স্মারক স্তম্ভ স্থাপিত হয় ১৯২৭ সালে। এটির আবরণ উন্মোচন করেছিলেনন রোনাল্ড রস নিজেই ।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy