একাধিক ভাষা জানলে যে মন খুলে যায়, এই সহজ সত্যটি কেবল বাঙালিরা ভুলে গিয়েছেন তা-ই নয়, মনে হয় অধিকাংশ ভারতীয়ই ভুলে গিয়েছেন। নানা ভাষা ও নানা মতের দেশ ভারতবর্ষে বহুভাষী বাঙালি এক সময় যে উদারতার অনুশীলন করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সেই অনুশীলন যে সর্বভারতীয় স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছিল, তা স্মরণ করা দরকার। এই সাংস্কৃতিক-রুদ্ধবায়ুগ্রস্ততা থেকে মুক্তি সেই স্মরণ-মননেই মিলতে পারে। আর এটাই বোধ হয় এ কালে রাজনৈতিক-ফ্যাসিবাদ চালিত সামাজিকতা থেকে বাইরে আসার উপায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এ দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ এক অর্থে উগ্র-একমাত্রিক সেকুলারের গুঁতোর বিপরীত প্রতিক্রিয়া।
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক অমিত শিলং পাহাড়ে যাঁর বই পড়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, তিনি সুনীতি চাটুজ্যে— অমিত পাহাড়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে পড়ছিল ‘সুনীতি চাটুজ্যের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব’। সুনীতিকুমার যে কেবল শব্দের মানুষ নন, উদার সংস্কৃতির মানুষ, তা রবীন্দ্রনাথ বিলক্ষণ জানতেন। সুনীতিবাবুর উদারতা মানে কিন্তু অপরকে অশ্রদ্ধা নয়, বিধিবিহীন অনিষ্ঠাও নয়। জাভাযাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন তিনি। উবুদ বলে একটি জায়গায় রাজার ঘরে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হবে। রাজা জানতে পারলেন, সুনীতিকুমার পারিবারিক ঐতিহ্যে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ। রাজা তাঁকে অনুরোধ করলেন বেদমন্ত্র পাঠ করতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘সুনীতি ব্রাহ্মণসজ্জায় ধূপধুনো জ্বালিয়ে মধুবাতা ঋতায়তে এবং কঠোপনিষদের শ্লোক প্রভৃতি উচ্চারণ করে শুভকর্ম সম্পন্ন করেন।’’ পৌরোহিত্যের জন্য অর্থগ্রহণ তিনি করেননি, এ তাঁর ‘ব্রাহ্মণবংশের রীতিবিরুদ্ধ’। ব্রাহ্মণ সুনীতিকুমারের আর এক রূপ প্রকাশিত হয়েছে শিষ্য সুকুমার সেনের লেখায়। ছাত্রকে চার্লি চ্যাপলিনের নতুন ছবি দেখতে উৎসাহ দিতেন তিনি, পড়তে বলতেন ও হেনরির গল্প। রামায়ণ নিয়ে নতুন করে ভাবতেও বলতেন। দেশ তখন অনেক দিনই স্বাধীন। আচার্য সুনীতিকুমারের ছাত্র সুকুমার সেন সে-সময় সুপ্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক। ১৯৭৫ সাল। দিল্লিতে রামায়ণ নিয়ে বড় সেমিনার হল। নভেম্বর কি ডিসেম্বর মাসে সুনীতিবাবু এশিয়াটিক সোসাইটিতে সেই রামায়ণ সেমিনারের কথা সাংবাদিকদের বললেন। সুকুমার সেনের স্মৃতিকথায় তার বিবরণ: ‘‘সুনীতিবাবু বলেছিলেন পালি জাতকের কাহিনী অনুসারে রাম-সীতা ছিলেন ভাই-বোন। একথা পড়ে গোঁড়ারা সুনীতিবাবুর উপর চটে গেলেন, বেশি গোঁড়ারা ক্ষেপে গেলেন। তাঁকে ভয় দেখিয়ে চিঠি আসতে লাগল। সুনীতিবাবু ভয় পাননি...’’ গোঁড়া রামবাদীদের ভয় সুকুমার সেনও পেতেন না। সুকুমার সেনের লেখা রামকথার প্রাক্-ইতিহাস বইটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন সুকুমারবাবুও রামকথার বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। প্রসঙ্গত বলতে ইচ্ছে করে বিবেকানন্দের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য যাঁরা পড়েছেন, তাঁরাও জানেন বিবেকানন্দও রামমুখী নন, রাম বিষয়ে শুচিবায়ুগ্রস্তও নন।
বেদ-উপনিষদ উচ্চারণ করেন সুনীতিবাবু, আবার রামকথার বহুত্ববাদেও বিশ্বাস করেন। এটাই যে ভারত-সংস্কৃতি, সে শিক্ষা তিনি জীবন থেকেই পেয়েছিলেন। সুনীতিকুমারের পিতামহ নব্বই বছর বয়সে ১৯০৬ সালে প্রয়াত হলেন। তখন সুনীতিকুমারের বয়স ষোলো বছর। তাঁর পিতামহ নিত্য গঙ্গাস্তোত্র আবৃত্তি করতেন। সে স্তোত্রের রচয়িতা দরাপ খাঁ গাজি। তরুণ সুনীতিকুমারকে ঠাকুরদা জানিয়েছিলেন, মুসলমান দরাপ খাঁ আমির ছিলেন, কিন্তু সংসার-বিরাগে এক সময় ফকির হয়ে গেলেন। ফকির দরাপ হিন্দু-মুসলমান ভেদ করতেন না। গঙ্গাস্তোত্রটি ফকির দরাপের রচিত। পারিবারিক সূত্রে শোনা এই গল্প পরবর্তী কালে সুনীতিকুমারের অনুসন্ধানের বিষয় হয়েছিল। তিনি তুর্কিয়ানা আর সুফিয়ানা এই দুইয়ের ভেদ করলেন। দরাপ এ দেশে লড়াই করতেই এসেছিলেন, কিন্তু লড়াই করে এ দেশের মানুষকে জয় করার জঙ্গিদর্শন এক সময় গেল বদলে। তার পরিবর্তে জেগে উঠল সুফিয়ানা। ‘‘তিনি গাজী অর্থাৎ তুর্কানা পথের যোদ্ধা হইতে, শেষে পীর অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার সাধক... সুফী হইয়া যান।’’ সুনীতিবাবুর বুঝতে অসুবিধে হয়নি ইসলামের ভারতীয় রূপ গড়ে ওঠার এই ছিল পথ।
১৯৪৪ সাল। দেশ স্বাধীনতার দিকে এগোচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার সুরও ক্রমে দু’পক্ষের কিছু মানুষ উচ্চকিত করে তুলছেন। দীর্ঘ দিনের রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের অধিকারী সুনীতিকুমার রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি জানেন, ‘‘ভারতবর্ষ বিসদৃশকেও সমাজবন্ধনে বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছে। যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করিয়া, সংযত করিয়া, তবে তাহাকে ঐক্যদান করা সম্ভব। সকলেই এক হইল বলিয়া আইন করিলেই এক হয় না।’’ (‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, রবীন্দ্রনাথ)
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর সুনীতিকুমারদের মতো মানুষকেই তো এই আদর্শ পালন করতে হবে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আর সঙ্কীর্ণ মুসলমানেরা পার্থক্যকে বড় করে তুলে দুই ধর্মের লড়াইকে, দেশের বিভাজনকে অনিবার্য ভবিষ্যৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। এরই মাঝে সমন্বয়ের কথা বলা ‘ন্যাশানালিস্ট মুসলমানেরা’ বিপদে পড়ছেন। সুনীতিকুমার এগিয়ে এলেন। নুর লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল রেজাউল করীমের বই সাধক দারা শিকোহ। সেই বইয়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ভূমিকা লিখলেন তিনি। রেজাউল করীমের পরিচয় দিলেন ‘উদারচেতা, দেশপ্রেমিক, সত্যদিদৃক্ষু ঐতিহাসিক, খাটি বাঙ্গালী এবং সত্যকার মুসলমান’ হিসেবে। সত্যকার মুসলমান হয়েও বাঙালি দেশপ্রেমিক হওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ তো একেই বলেছিলেন বিসদৃশের সমাজবন্ধন। সবাইকে আইন করে এক করা যায় না, ভারতীয় সমাজ আইনের বাইরে পরস্পর পরস্পরকে জায়গা দিয়েছে। পার্থক্যকে খুঁচিয়ে তুলে সামনে না এনে নিজেদের একটি পরিচয় বজায় রেখেও অন্য পরিচয়কে বরণ করেছে। পার্থক্য খুঁচিয়ে তোলার সে দিনের রাজনীতি আজ যখন নব কলেবরে আবার মাথা তুলেছে— শুধু তা-ই নয়, পার্থক্যের রাজনীতিকে আইনসিদ্ধ করতে চাইছে— তখন সুনীতিকুমাররাই ভরসা। বেদমন্ত্রে ও সুফিয়ানায়, ব্রাহ্মণত্বে ও ভারতীয় ইসলামে তাঁর ন্যায়সঙ্গত শ্রদ্ধা।
এই কথাগুলি সে কালের যুবকদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ২১ ফাল্গুন। পশ্চিম দিনাজপুরের হিলিতে হিন্দু-যুবক-সম্মিলনীতে সভাপতির অভিভাষণ দিলেন সুনীতিকুমার। সে অভিভাষণের লিখিত রূপের নাম ‘ভারতধর্ম ও হিন্দু যুবকের কর্তব্য’। হিন্দু যুবকেরা হিন্দুত্ববাদী হবেন না। ‘অসহিষ্ণু বিজিগীষু সাম্রাজ্য-ধর্ম’ (intolerant militant imperialism) হিন্দুর ধর্ম নয়। তাদের বুঝতে হবে ভারতবর্ষ মুসলমানেরও। সুনীতিকুমার জানিয়ে দেন, ‘ভারতীয় মুসলমান সভ্যতা’র স্বরূপ বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতাটি স্মরণ করেন তিনি। ভারতীয় মনোভাবের সঙ্গে সহযোগিতা করে যে ভারতীয় মুসলমান সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেই সভ্যতা জগৎকে দান করেছে ‘‘কবীর, আকবর, দারা শিকোহ্; দিল্লী আগ্রার বাস্তু শিল্প, তাজমহল, মোতী মসজিদ; মোগল চিত্র-রীতি; খেয়াল প্রভৃতিতে ভারতীয় সংগীতের নোতুন বিকাশ; নানা নোতুন ভারতীয় শিল্প; হিন্দুস্থানী ভাষা।’’ তাঁর এই তালিকা পড়তে পড়তে কালিকারঞ্জন কানুনগোর ইংরেজি পুস্তিকা ইমপ্যাক্ট অব ইসলাম-এর কথা মনে পড়ে যায়।
এই যে ভারতীয় সংস্কৃতির নানাত্বকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সুনীতিকুমার, তা তাঁর বহু-ভাষাজ্ঞানের প্রত্যক্ষ ফল। বহু-ভাষার জ্ঞান আমাদের সংস্কৃতির নানাত্বকে বুঝতে সহায়তা করে। যদিও সুনীতিকুমার ভাষাতাত্ত্বিক, তবু ক্রমশই তাঁর আগ্রহ ভাষার পথ দিয়ে সাংস্কৃতিক নানাত্বের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। চমৎকার ছবি আঁকতে পারতেন তিনি, বানিয়ে ফেলতে পারতেন নানা রকম বস্ত্র। বন্ধু নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের নাটকের জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন পোশাক। সুনীতিবাবুর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িটি এখন খ্যাতনামা বস্ত্র-প্রসাধন বিপণনকেন্দ্র। নিত্য নানাভাষী মানুষের সেখানে যাতায়াত। অথচ তাঁদের অধিকাংশই জানেন না, এই বাড়িটি একদা যাঁর বাসক্ষেত্র ছিল তিনি বহুত্ববাদী ভারতের সাধক ছিলেন। সেই ভারত ধর্ম-বিবিক্ত অর্থে সেকুলার নয়, এ কালের উগ্র রাষ্ট্রবাদী হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীও নয়। সে ভারত উদার, বহুমুখী, বহুভাষী।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy