মন্বন্তর আমাদের স্মৃতি থেকে উবে গিয়েছে ! অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
১৯৪৭-এর জুন মাসেই ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আমাদের জানালেন, আর মাত্র মাস দু’য়েক পরেই দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন শেষ হতে চলেছে, আমরা স্বাধীন হচ্ছি। একই সঙ্গে জানা গেল, দেশটার মানচিত্র কিন্তু পালটে যাবে, ‘পার্টিশন’ হবে। এ-ও জানা গেল, দেশের পরম পুরুষ মোহনদাস গাঁধীর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছে,তিনি জানিয়েছেন, পার্টিশন হলে তা করতে হবে তাঁর শবদেহের উপর। লোকসমাজ বিমূঢ়প্রায়, বিস্মিত, ক্ষুব্ধ। কিন্তু তাতে কী? ১৫ অগস্টের মধ্যরাত্রে একদিকে পণ্ডিত নেহরুর আবেগঘন বক্তৃতা যখন চরাচরে শিহরণ জাগায়, অন্যদিকে তখন ছিন্নমূল মানুষের ঢল নামে,শুরু হয় দেশান্তরের দুঃস্বপ্নশঙ্কুল রোজনামচা। অন্তরাত্মার কান্না থামিয়ে গাঁধীও জানালেন, দু’শো বছরের শাসনক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়া নাকি ব্রিটিশ জাতির সর্বোত্তম কীর্তি (‘নোবলেস্ট অ্যাক্ট অব দ্য ব্রিটিশ নেশন’)।
কীর্তি, নাকি কীর্তিনাশা? মুসলমান জনগোষ্ঠী যাবে পাকিস্তানে আর হিন্দুরা যাবে হিন্দুস্তানে। এককথায়, জনবিনিময়। এই বিনিময় প্রথায় রাজনীতিকদের আপত্তি ছিল না, কেননা জনমানুষ তো বস্তুই। নিছক বস্তুর চেয়ে বেশি সমাদর যে জনমানুষের প্রাপ্য না সেকথা মাউন্টব্যাটেনের মতোই বুঝেছিলেন জিন্না, বুঝেছিলেন নেহরু-পটেলরাও। আর বিলিতি আইনজ্ঞ র্যাডক্লিফ সাহেব যখন মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে এত বড় দেশটার বুক চিরে ফালা ফালা করে তিনটে টুকরো করার বরাত পেলেন তখন তাঁরও বুক কাঁপেনি। পোঁটলা-পুঁটলি সমেত সেই দেশান্তরী বস্তুসমষ্টির সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। আর মৃতদেহের সংখ্যা ছিল দশ লক্ষ। এত বড় রক্তাক্ত জনবিনিময় আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে আর কোথাও ঘটেনি। ’৫১ সালের জনগণনায় বোঝা গেল, বাংলায় না-হলেও পঞ্জাবের দিকে বিনিময়ের হার ছিল প্রায় সমান সমান।
তাতে প্রমাণ হল, আজকের মতো তখনও আমাদের রাজনীতিকরা অঙ্কে তেমন কাঁচা ছিলেন না। অঙ্ক কষেই তাঁরা বুঝেছিলেন, একই দিনে কারও আহ্লাদ উথলে ওঠে, কেউ শোকে স্তব্ধবাক হয়ে যায়,তা নিয়ে হা-হুতাশ অর্থহীন। তার চেয়ে ভাল, কাজের কাজে মন দেওয়া। ১৫ অগস্ট আমরা যা পেয়েছিলাম তা হল, ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’। মানে, এখন থেকে আমরাই নিজেদেরকে শাসন করব, তবে একই সঙ্গে ইংল্যান্ডের রানির মর্যাদাও রক্ষা করে চলতে হবে। স্বাধীন, কিন্তু ফ্রিডম বা মুক্তির অর্থে স্বাধীনতা না। কারণ, শুধু সংবিধানই নয়, সিভিল আইন, ক্রিমিনাল আইন, পুলিশ থেকে সেনাবাহিনী—সবই যা ব্রিটিশরা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছে সেই অনুযায়ীই চলবে। এমনকি, সুভাষের ‘আইএনএ’-ও থাকবে নিষিদ্ধ, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তার জায়গা হবে না। এই সবই আসলে কাজের কাজ।
আরও পড়ুন: বিদ্বেষের রাজনীতি সর্বজনীন উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারে না
তার পর থেকে আজ অবধি রাজনীতিকরা কাজের কাজেই মন দিয়েছেন। তাঁরা বোধহয় সংক্রামক প্রাণী,তাই আমরাও তাঁদের প্রেরণায় সংক্রমিত হয়েছি। তিয়াত্তর বছর পার হয়েছে, কালোবাজারি ল্যাম্পপোস্টে ঝুলছে, এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য আমরা সিনেমা-থিয়েটারেও দেখিনি, কোনও ‘দুর্মর বসন্তের দ্বিধাকম্পিত পদধ্বনি’ শুনতে পাইনি।অতএব বুঝে গিয়েছি, স্বাধীনতা আসলে একটা দিবাস্বপ্ন।
স্বাধীনতার প্রথম দিনে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা ছিল এমনই।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, ‘নতুন-যুগ-সূর্য উঠিল ছুটিল তিমির রাত্রি’। আর বিজ্ঞাপনের পাতায় ‘হাওড়া মোটর কোম্পানি’ জানিয়েছিল, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রতিটি মোটরগাড়িতে একটি সুশোভন জাতীয় পতাকা বিনামূল্যে লাগিয়ে দেওয়া হবে। তার পর থেকে একেবারে বিনামূল্যে না-হলেও, খদ্দর আর সিল্কের জাতীয় পতাকার কোনও অভাব কখনও হয়নি, সূর্যও নিয়মমতো উঠেছে,তবু ‘তিমির রাত্রি’ আজও কাটেনি। আমাদের ‘মুক্ত প্রাণে মুক্ত ইচ্ছার সিন্দুকে’ সেই যে কবে তালা পড়ে গিয়েছে, তা আজও খোলেনি।
তালা আমরাই লাগিয়েছি। মন্বন্তর আমাদের স্মৃতি থেকে উবে গিয়েছে, দেশভাগের সেই বীভৎস দিনগুলো আমরা মনে রাখতে চাইনি, শোকের দৃশ্যগুলো প্রাণপণে ভুলতে চেয়েছি। তাই বার্লিনে ‘হলোকাস্ট মেমোরিয়াল’ থাকে, আর আমরা চিত্তপ্রসাদের আঁকা ছবিগুলো খুঁজেই পাই না। তারই অমোঘ পরিণামে স্বাধীনতা হয়ে গিয়েছে শুধু শাসকের, শাসিতের না,তার আছে শুধু স্বাধীনতার আলখাল্লা, যেকোনও মুহূর্তে শাসক তা খুলে দিতে পারে। খুলে দেওয়ার মহড়া বারবার ঘটেছে,আর ইদানিং তো এ-ও জানলাম, আমাদের মতামত যদি শাসকের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে তার গলা টিপে ধরা আইনত সিদ্ধ। তেমন হলে ‘এনকাউন্টার’ করে ফেলা আইনসিদ্ধ না-হলেও প্রথাসিদ্ধ। কোনও অর্থেই আমাদের মুক্তি ঘটেনি, তাই মুক্তমনা হতে আজও আমাদের গড়িমসি। ওদিকে অপার স্বাধীনতার অন্য দুই ভোক্তা যে সুপ্রিম কোর্ট আর শাসকপ্রিয় সংবাদমাধ্যম সেকথা বুঝতে দেরি হয়ে যায়।
দেশভাগের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে চেয়েছে অনেকেই। হারিয়ে গিয়েছে শিল্প কর্ম।
শুধু দেরিই না, এমনই মর্ষিত, অবসন্ন আমাদের মন যে, একটা সংক্রামক অণুজীবের আগমনে আমরা যারপরনাই বিস্রস্ত, ক্লিষ্ট। এতটাই যে, শাসকের উদ্ভট ইঙ্গিতে বিচার-বিবেচনার সমাধি রচনা করে ফেললাম। আমরা ভেবেই উঠতে পারলাম না, মুকুটপরা এই অণুজীব যতটা সংক্রামক ততটা মারক না। ভেবেও দেখলাম না যে, স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অজুহাত খোঁজা শাসকের ধর্ম। বরং নিঃশব্দে নীরবে নিজ নিজ গুহায় ঢুকে পড়ে ভাবলাম, যাক বাঁচা গেল! কতদিনের জন্য, কীভাবে বাঁচা গেল তা ভাবিনি, প্রতিবেশে অপেক্ষমান নতুন অণুজীবগুলোর বেলায় কোন কোন অভাবনীয় কৌশল বলবৎ হবে সেকথা ভাবিনি। ‘লকডাউন’ থেকে যে ‘লক আউট’ আসতে বাধ্য, তার মানে মন্বন্তর, সেকথা ভাবিনি।
যেভাবে একটা নাতিভয়ানক সংক্রমণকে ছুতো করে দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান দীর্ঘকালীন কোয়রান্টিনে চলে গেল, তার সঙ্গে দেখা-শোনা-মোলাকাত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল, তার অদূরপ্রসারী ফল যে অতিভয়ানক তা বুঝতে বিজ্ঞানী হতে হয় না। যে-লকডাউন আর ‘কন্টেনমেন্ট জোন’ নিয়ে এখন আমাদের প্রায় নাভিশ্বাস, কাশ্মীরে তার চেয়েও শতগুণ বেশি লকডাউন চলছে প্রায় এক বছর ধরে। এমনই পরাধীন, অবিবেকি মন আমাদের যে, সেকথা ভুলেছি। মিডিয়ার একাংশে প্রতিদিন সংক্রমণ নিয়ে আরব্য রজনীর গপ্পো শুনতে শুনতে আমরা ক্রমশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিআর ওদিকে শোনা যায়, কাশ্মীরের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ ইতিমধ্যেই কোনও না-কোনও মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় জানালেন, তিনি একসময় ভাবতেন, ভারতে গণতন্ত্র আছে মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ। শাসকের ভাবগতিক দেখে এখন তাঁর মনে হয়, গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের অনুপাতটা হয়তো ৩০ আর ৭০।
আরও পড়ুন: কোনও বড় নেতার দলবিরোধী কাজও কি প্রশংসার যোগ্য
তাই স্বাধীনতার অমন হালহকিকত দেখে মনে হয়, যে-তিরিশ ভাগ স্বাধীনতা টিকে আছে তা বুঝি কান্নার স্বাধীনতা, তিলে তিলে অপমানিত, লাঞ্ছিত, দগ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা। তাই দেখি, আমাদের এলিটবর্গ প্রতিদিন ‘কোভিড’-এ মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে দিশেহারা, অথচ যাঁরা এলিট নন তাঁদের ঘরে প্রতি দুই মিনিটে একটি শিশু ডায়ারিয়া অথবা নিউমোনিয়ায় মারা যায়,ওটা সংবাদ হয় না, জনস্বাস্থ্যের হেঁয়ালিই অমন। জনস্বাস্থ্যের মাত্র পাঁচটি বুনিয়াদ: মাথার উপরে ছাদ, তিন বেলা আহার, পরিস্রুত পানীয় জল, শৌচাগার আর নারীর হাতে আর্থিক ক্ষমতা। এর একটিও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। তার বদলে গড়েছি ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ আর ‘কোভিড’ হাসপাতাল। তাই জনস্বাস্থ্যের স্বাধীনতাও নেই, শুধু হেঁয়ালি আছে, আর আছে পুলিশের নির্বোধ দাপট। সে তো ’৪৭-এর আগেও ছিল। তাহলে?
‘এনকাউন্টার’ করে ফেলা আইনসিদ্ধ না-হলেও প্রথাসিদ্ধ!
শুনেছি, বোমাবিধ্বস্ত সিরিয়ায় তিন বছরের শিশু মৃত্যুর আগে গোঙাতে গোঙাতে বলেছিল, আমি আল্লাকে সব বলে দেব। সবাই শুনেছে। আমাদের দেশেও প্রতিদিন পেটে একরাশ খিদে নিয়ে শুধু খাবারের স্বপ্ন দেখতে দেখতে যে-তিন হাজার শিশু মারা যায় তারাও তো মৃত্যুর আগে একই কথা বলে,আমরা কি শুনতে পাই, শুনতে চাই? তাহলে স্বাধীনতার গণিতটা ঠিক কেমন, কে বলে দেবে?
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy