জন্মভূমির বিদেশ হয়ে যাওয়ার দিন।
যাঁরা তিয়াত্তরটি স্বাধীনতা দিবস দেখেছেন এ রকম লোক কিছু নিশ্চয় আছে দুই বাংলায়। আমি তাঁদের এক জন, তবে আর ক’টি এমন দিবস আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আমি জানি না, খুব আশা আর উল্লাস নিয়ে বসে আছি, এমনও নয়।
প্রথম স্বাধীনতা দিবস আমি যেটি দেখেছিলাম এবং পটকা ফাটিয়ে উদযাপন করেছিলাম— অভিভাবকদের চক্ষুকে রক্তাক্ত এবং কণ্ঠকে সগর্জন করে, সেটি ভারতের স্বাধীনতা নয়, পাকিস্তানের জন্মোৎসব। দূর পূর্ব বাংলার গ্রামের স্কুলে মুসলিম লিগের লোকেরা এসে আমাদের ছাত্রদের প্রত্যেককে দু’খানা করে পটকা উপহার দিয়েছিল, ১৪ অগস্ট তারিখে পাকিস্তানের জন্মমুহূর্ত পালনের জন্য। তখন বুঝিনি ভারত স্বাধীন হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে রেডিয়ো ইত্যাদি দূর অস্ত্, তাই পণ্ডিত নেহরুর Tryst with Destiny বক্তৃতাও শুনিনি। শুনলেও ক্লাস ফোরের গ্রামীণ বালক সে ইংরেজি বুঝতে পারত না। কাজেই প্রথম ১৪ই বা ১৫ই অগস্ট আমার কাছে পাকিস্তানের জন্মদিন। আমার জন্মভূমির বিদেশ হয়ে যাওয়ার দিন। ওই দিন আমি আমার জন্মভূমিকে হারালাম, সেই সঙ্গে আরও অনেক কিছু। না, আমাদের কোনও শারীরিক বা অবস্থানগত ক্ষতি হয়নি, কিন্তু তারই পরিণামে আমাদের ওই বছর নভেম্বরের গোড়ায় প্রথমে নৌকোয়, তার পর ঘোড়ার গাড়িতে, তার পর স্টিমারে, তার পরে রেলে—তিন দিনের বিচিত্র ভ্রমণে, ঢাকা জেলার সেই অখ্যাত গ্রাম থেকে শেয়ালদা স্টেশনে এসে পড়তে হল। পথে দর্শনা স্টেশনে ‘পাকিস্তানি’ পুলিশের খানাতল্লাশি আর অসম্মান সহ্য করলেন বড়রা। দশ বছরের বালককে সে সব বিস্ফারিত চোখে দেখতে হল।
না, অন্যেরা আরও বহু অসম্মান আর বিপর্যয় সহ্য করেছেন। মৃত্যু, লুণ্ঠন, মেয়েদের অসম্মান, ত্রাণশিবিরের ভয়াবহ দুর্গতি তাঁদের জুটেছে, আমার অভিভাবকেরা (মূলত নারী) কোনওক্রমে খাড়া থেকে মাথা তোলবার চেষ্টা করেছিলেন। তার কথা অন্যত্র বলা আছে। এখানে যে কথা বলবার তা হল, ১৯৪৮-এর পনেরোই অগস্টেই আমি লক্ষ করলাম আনন্দবাজার পত্রিকা-র রঙিন ক্রোড়পত্র, যার মাথায় দু-পৃষ্ঠা ছড়িয়ে লেখা— সম্ভবত কংগ্রেস সাহিত্য সংঘের সুকৃতি সেনের গানের লাইন— ‘জাগে নবভারতের জনতা, এক জাতি, এক প্রাণ, একতা।’ তখন কাগজের পৃষ্ঠায় রং কদাচিৎ পাওয়া যেত। পনেরো অগস্ট, এবং পরে ছাব্বিশ জানুয়ারি ছিল দুটি দিন— যে দিন কাগজে রঙিন ক্রোড়পত্র পেতাম আমরা।
এ তো দ্বিতীয় পনেরো অগস্টের কথা। অনেক পরে ভারতে প্রথম পনেরো অগস্টের কথা আমি পড়েছি, নানা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে। তার ঠিক এক বছর আগেই ১৯৪৬-এর ১৬ অগস্ট কলকাতায় হয়ে গেছে হিন্দু-মুসলমানের ভয়ংকর দাঙ্গা, সুরাবর্দির ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ অনুসারে ‘দ গ্রেট ক্যালকাটা কিল্লিংস’। কিন্তু এক বছর পরে সেই হিংস্রতার স্মৃতিকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরছে, লাড্ডু, অন্যান্য মিষ্টি আর শরবত খাওয়াচ্ছে— এই গলায় ডেলা-আটকানো দৃশ্যও দেখেছে কলকাতা। তখন অনেকেই ভেবেছিল, এই হবে বছর বছর পনেরো অগস্টের রূপ, এই একই চিত্রনাট্য বার বার পুনরভিনীত হবে।
১৯৪৬-এর হিংস্রতার স্মৃতিকে উৎখাত করে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পরস্পরকে লাড্ডু, মিষ্টি, শরবত খাওয়াচ্ছে।
আর-একটা জিনিস অনেকে ভেবেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল। বিশেষ করে আমাদের মতো উদ্বাস্তু বালকবালিকাদের অভিভাবকেরা। তা হল, পনেরো অগস্ট যেহেতু ঋষি অরবিন্দেরও জন্মদিন, তিনি নাকি বলেছেন (জানি না সত্যই তিনি এ কথাটা বলেছিলেন কি না) যে, চিন্তা কোরো না, ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হল, ঠিক দশ বছর পরে, ১৯৫৭-র পনেরোই অগস্ট আবার দুই দেশ জুড়ে যাবে। এই ভাগ টিকবে না!’ এই প্রচারে বিশ্বাস করে আমরা বিপুলভাবে হেরেছি। পূর্ব পাকিস্তানে পর পর দাঙ্গা আরও আরও বেশি হিন্দুকে সে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে, দেশভাগ অপ্রতিরোধ্য, অনপনেয় হয়ে এই দক্ষিণ এশীয় ভূগোলে আসন নিয়েছে।
কেন বাছা হয়েছিল পনেরো অগস্ট তারিখটা? আমি তার স্পষ্ট উল্লেখ কোথাও পাইনি। কিন্তু ১৯৪৫-এর পনেরো অগস্টের আগে কিছু ঘটনা ঘটে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনী ব্যর্থ হয়, জাপানে পর পর দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের ফলে জাপানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পরিণামে জাপানের পট্সডাম শান্তিচুক্তি মেনে চলার ঘোষণা করে ওই পনেরো অগস্ট (১৯৪৫)। মিত্রবাহিনীর বিজয়ের দিনের স্মৃতি বহন করছে ভারতকে কেটে তিন খণ্ড করে সেখান থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিদায়ের দিন?
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মহম্মদ আলি জিন্নার দুই জাতিতত্ত্ব, আর তার ভিত্তিতে তৈরি পাকিস্তানও জেতেনি। সে দেশেরও দেশভাগ হয়েছে, ১৯৭১ সালে তা ভেঙে বাংলাদেশের ‘তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়’ ঘটেছে। সেখানে তাতে অখুশি হওয়ার লোকও ছিল। তাই ১৯৭৫ সালে তারা বাংলাদেশের স্থপতি, ভারতবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, আর তারিখটা বেছে নেয় ১৫ অগস্ট।
এই উপমহাদেশে পনেরো অগস্টের ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করার যোগ্যতা নেই, আমাদের লক্ষ্যও তা নয়। আমরা বরং এবারকার, এই আসন্ন পনেরো আগস্ট নিয়ে দু-একটি কথা বলি।
বছরের শুরু থেকে এ বারের পনেরো অগস্টে পৌঁছনো আমাদের পক্ষে খুব মসৃণ হয়নি। ফেব্রুয়ারি থেকেই পৃথিবীকে আক্রমণ করেছে এক ভয়াবহ অতিমারি, এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লক্ষের বেশি লোক তাতে মারা গেছে, আমাদের পরিচিত এবং প্রিয় আর বিখ্যাত মানুষেরাও তারই আক্রমণে বিদায় নিয়েছেন। সেই মৃত্যুপাত অব্যাহত আছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পনেরো অগস্ট তো শুধু একটা দিন ছিল না, তা আমাদের অনেক কিছুর প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল। যেমন গণতন্ত্রের। লক্ষ করি, ভারতে সেই গণতন্ত্রের চেহারাটা এর মধ্যেই বেশ ছন্নছাড়া হয়ে এসেছে। কাশ্মীরের যে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারায়, তা লুপ্ত করে কাশ্মীরকে প্রায় বন্দি এক অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। তার জননেতারা জেলখানায়, তার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ। নানা রাজ্যে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার ফেলা হয়েছে— মধ্যপ্রদেশে যেমন— রাজস্থানে সেই চেষ্টা চলছে। এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় শাসকদল অতিশয় নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে। হাটের গরুছাগলের মতো কোটি কোটি টাকায় জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা চলছে। ‘আয়ারাম-গয়ারাম’-প্রসিদ্ধ এই ব্যাধি আগেও ছিল, এই সরকারের আমলে তা শিল্পে পরিণত হয়েছে। দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে ‘ভোট’ কথাটার চেয়ে ‘ভোট-লুট’ কথাটা বেশি পরিচিত আর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের জলাঞ্জলির নিরুপায় সাক্ষী হয়ে থাকছে এই পনেরোই অগস্ট। করোনার ফলে যে আর্থিক বিপর্যয়, বেকারি আর ক্ষুধা আমাদের গিলতে আসছে— মৃত্যুর কথা ছেড়েই দিলাম— সেখানে সরকার ফেলাই যেন অগ্রধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। সেই সঙ্গে আছে যুক্তিবাদীদের হত্যার পরম্পরা— গোবিন্দ পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ আর কালবুর্গীর, আর আছে বিরোধীদের বন্ধন, আশি-উত্তীর্ণ অসুস্থ কবি ভারাভারা রাওয়ের কারাবাস।
দেশের সেই সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাও আজ সাম্প্রদায়িক করোনায় সংক্রামিত।
হ্যাঁ, আসন্ন নির্বাচনগুলির দিকে পাখির চোখ রেখে আরও অনেক কিছু চলছে। উনত্রিশে জুলাই নিক্ষেপ করা হল এক নতুন শিক্ষানীতি, যাতে মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা তুলে দেওয়া হল, বিষয়ের অগাধ স্বাধীনতা দেওয়া হল, কিন্তু বলা হল না যে, তার টাকাপয়সা খরচখরচা কে দেবে। ৬ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রথম সম্পাদকীয়তে যথার্থই বলা হয়েছে, ঢালাও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু গৌরী সেনের সন্ধান দেওয়া হয়নি। না, আছে একটা কথা। কলেজগুলিকে ‘আর্থিক স্বাধিকার’ দেওয়া হবে। এতে কলেজগুলো মরবে, গ্রামের কলেজগুলো আগে। মিশনারি আর বেসরকারি কলেজ বাদ দিয়ে সরকারি কলেজে কে টাকা ঢালবে? ছাত্রদের মাইনে বাড়ালে বহু ছাত্রছাত্রীর কলেজে আসা বন্ধ হবে তাতে সন্দেহ নেই।
শেষ মোক্ষম চাল হল অযোধ্যার নতুন রামমন্দিরের ‘ভূমিপূজা’। সংবিধানে লিখিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশের প্রধানমন্ত্রী তাতে অংশ নিলেন। দারুণ উৎসব হল, তবে সুখের কথা, দেশের এ দিনটা নির্বিঘ্নে কেটেছে। দেশের সেই সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাও আজ সাম্প্রদায়িক করোনায় সংক্রামিত।
এক পনেরো অগস্টে আমরা অনেকে আমাদের জন্মভূমির সঙ্গে আরও অনেক কিছুকেই হারিয়েছিলাম। এ বারে কি তা হলে স্বয়ং পনেরো অগস্টকেই আমরা হারাতে চলেছি?
(অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy