মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/আমি তোমাদেরই লোক’— কোন্ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ এ কথা লিখেছিলেন, তা না জেনেও বলা যায়, তিনি অতিসাধারণ মানুষের মধ্যেই বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজকের এই ভয়ঙ্কর সময়ে ‘তোমাদের লোক’ হয়ে ওঠার যে নানা তথাকথিত প্রয়াস সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে, সেখানে শিক্ষাঙ্গনও ব্যতিক্রম নয়। আর ‘তোমাদের লোক’ যদি না হলে কপালে দুঃখ আছে!
সুদিন আসার স্বপ্ন যখন ভারত সবে দেখতে শুরু করেছে, নানা রকম যোগাভ্যাসের মাধ্যমে মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি করছে এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়ার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল ভারত নানা সরঞ্জাম পেতে শুরু করেছে, তখন আমাদের মনে হচ্ছিল, মানসিক উৎকর্ষ এবং মুক্তচিন্তার প্রসার হয়তো বৃদ্ধি পাবে! হয়তো পরমতসহিষ্ণুতা, পরধর্মসহিষ্ণুতা আমাদের ভাবনার অগ্রাধিকারে আসবে! ভারতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরদিনই তাদের জ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত রেখেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের তক্ষশীলা, নালন্দার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলি জ্ঞানের চর্চা করেছিল বলেই বিশ্বের বহুদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে এসেছিলেন। বর্তমান ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আধুনিক মন ও মনন অনেক সময় রাজশক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিভাজন ও দলাদলি যেমন দেশের অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে, তেমনই আবার মতাদর্শগত পার্থক্য পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু দেশের সার্বিক মঙ্গল এবং মনুষ্যত্বের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক! জাগ্রত বিবেক এবং শুভবুদ্ধি মানুষকে ঠিক পথ দেখায়।
বর্তমান ভারতে যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগণ্য, তার মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য। পরাধীন ভারতে যখন দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ স্বদেশিয়ানার হাওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হয়ে দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে শুরু করেছেন, তখন ১৯০৬ সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ স্থাপিত হয়। ১৯০৬ সালের ১১ মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৯২ জন সদস্যকে নিয়ে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। বয়কট আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের জারি করা কার্লাইল সার্কুলার, লিয়ন সার্কুলার, পেডলার সার্কুলারের বিরোধিতায় ছাত্রদের বিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা শুরু হয়। তখনই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়, যা পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।
শুরু থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষায় এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। ঠিক একই ভাবে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, মানববিদ্যা, আন্তর্জাতিক অধ্যায়ন প্রভৃতির উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য অচিরেই স্বীকৃতি পেয়েছিল এই শিক্ষাঙ্গন। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রেও এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অনেক। আমরা যদি বিগত বছরগুলির দিকে লক্ষ করি, তা হলে দেখতে পাব, প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে রয়েছে। অধিকামশ সময়ে মূলত বাম মতাদর্শ প্রাধান্য পেলেও সার্বিক ভাবে মানবিকতার শিক্ষা ও ভাবনাই এখানে সব সময় গুরুত্ব পেয়েছে।
আজ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনা আমাদের মনে একটা বড় প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে, তা হল, রাতের অন্ধকারে মুখে কালো কাপড় বেঁধে একদল ঠোঙাড়ে বাহিনী পড়ুয়াদের হস্টেলে আক্রমণ চালিয়ে ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি ঘরের আসবাব ও জিনিসপত্র নষ্ট করেছে এবং নির্দয় ভাবে পিটিয়েছে। মাথায় ১৬টি সেলাই নিয়ে সংসদের সভানেত্রীর করুণ মুখ বা শিক্ষকের ভয়ার্ত মুখ আমরা দেখেছি!
এত রক্ত কেন? কেন এই পিষে ফেলার মানসিকতা? শুধুমাত্র মতাদর্শগত লড়াই? না কি আরও অন্য কিছু? জেএনইউ থেকে জেইউ— উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ই বারবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। বিশ্বের সেরা মেধাচর্চার অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানগুলি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে আর শুধ মাত্র মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী মানবিকতাকে উপেক্ষা করে, প্রতিবাদের ভাষাকে অবজ্ঞা করে তাদের ধ্বংস করতে চেয়েছে। যাদবপুরে যা ঘটেছে, দিল্লিতে তার ব্যতিক্রম হয়নি। উল্টোটাও সত্য। রাজনৈতিক আগ্রাসন এবং পরমত অসহিষ্ণুতা আসলে ধ্বংসকারী ভারতের জন্ম দিতে চলেছে। ‘আমি মারের সাগর পারি দেব’— শুধু মুখে বললেই হবে না! এখন সেই বিপন্ন সময় এসেছে, যেখানে ওদের মারের উপর দিয়ে ফুল নিয়ে আসতে হবে আধুনিক ভারতের জন্য। শিক্ষার্থীরা আগ্রাসী পরমত অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে জয়ধ্বজা তুলে ধরেছেন। সারা দেশ আজ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে। বিশ্বাস— শিক্ষাঙ্গনই দেশের এই বিপন্নতাকে প্রতিরোধ করবে। আলোর দিশা দেখাবে।
(লেখক গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy