তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর, গল্পকার তারাশঙ্কর, নাট্যকার তারাশঙ্কর আমাদের খুবই চেনা। এমনকি আমরা চিনি কবি বা গীতিকার তারাশঙ্করকেও। হয়তো বা প্রাবন্ধিক তারাশঙ্করকেও চিনি। কিন্তু সাংবাদিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বড়ই অচেনা। অথচ জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এই সাংবাদিকতার কাজ তাঁকে গ্রহণ করতে হয়েছিল কতকটা দায়ে পড়েই। জামাতা শান্তিশঙ্কর মারা গিয়েছেন। তাঁর বিধবা স্ত্রী (তারাশঙ্করের বড় মেয়ে গঙ্গা দেবী), তিনটি কন্যা ও একটি পুত্র, সকলের দায় তারাশঙ্করের কাঁধে। ‘বৃদ্ধ জীর্ণপক্ষ পাখির মতো’ খাবার খুঁটে এনে অসহায় নাতি-নাতনিদের খাওয়াতে হবে। এই অবস্থায় তারাশঙ্কর যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ নেন। তাঁর আত্মজীবনীর শেষ পর্ব ‘আমার কথা’য় তিনি বলেছেন, ‘‘আমাকে এগিয়ে যেতে হয়নি আমার দুর্দিনে, তুষারবাবুই ঘটনাটি জানতে পেরে নিজেই এগিয়ে এসে সমাদর করে আহ্বান জানালেন।’’ তবে এই কাজ নেওয়ার জন্যও তারাশঙ্করকে অনেক নিন্দামন্দ সহ্য করতে হয়েছিল।
১৯৬৩ সালের ২৭ জুলাই থেকে ১৯৬৭ সালের জুন পর্যন্ত চার বছর ধরে প্রতি শনিবার যুগান্তরের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় তিনি গ্রাম বাংলার সংবাদ লিখতেন ‘গ্রামের চিঠি’ নামে। গ্রামের চিঠিতে তারাশঙ্কর লিখেছেন গ্রামের চাষবাস, জলহাওয়ার কথা, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা, গ্রামের ক্রমপরিবর্তনের কথা। প্রথম চিঠিতে ভারতবর্ষে গ্রামের গুরুত্ব ও তার পরিস্থিতির পরিবর্তনের কথা দিয়ে মুখবন্ধ রচনার পরে দ্বিতীয় চিঠিতেই চলে গিয়েছেন নিজের গ্রাম লাভপুরের ভৌগোলিক বিবরণের কথায়। চতুর্থ চিঠিতে লাভপুরের শিক্ষা-সংস্কৃতির বর্ণনা। আবার তৃতীয় চিঠিতে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের অন্তর্কলহের প্রসঙ্গ টেনে বীরভূম জেলায় সেই কলহের বিস্তৃত বিবরণ। এ-সব চিঠি যখন লিখছেন তারাশঙ্কর, তখন তিনি রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলের সদস্য। অথচ কংগ্রেসের অন্তর্কলহ, দুর্নীতি সম্পর্কে সমালোচনায় তাঁর কুন্ঠাবোধ নেই। ফলত, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল্লির হাই কমান্ড পর্যন্ত পৌঁছেছিল বলে মনে হয়। কারণ সেসময় একটি চিঠিতে তারাশঙ্কর লিখছেন, ‘‘...আমার দিক থেকেও সত্যকে প্রকাশ করতে ভীত আমি কোনদিন হব না। কারণ লেখক এক সত্যের কমাণ্ড ছাড়া অন্য কোন কমাণ্ডের অধীন নন। আমিও নই।”
তাঁর এই গ্রামের চিঠিতে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষের রাজনীতির কথা বারবার এসেছে। তাতে সুস্পষ্ট ভাবে তারাশঙ্করের রাজনৈতিক বিশ্বাসের পরিচয় মেলে। কিন্তু রাজনীতির কথা থেকে বারবার তিনি ফিরে গিয়েছেন গ্রামের কথায়। তাঁর অবলম্বন হয়তো লাভপুর, কীর্ণাহার বা বীরভূমের গ্রামগুলি, কিন্তু সেগুলিকে কেন্দ্র করেই তিনি সামগ্রিক ভাবে গ্রামবাংলা বা গ্রাম-ভারতের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। গ্রামের দলাদলির কথা, গ্রাম সমাজের কুশ্রীতার কথা বলতে গিয়ে উঠে এসেছে সাহিত্যের কথাও। ছকু চাটুজ্যের জবানিতে তিনি বলেছেন, ‘‘শরৎচন্দ্র এ বীজাণুর নাম দিয়াছেন গোবিন্দ গাঙ্গুলী (পল্লীসমাজ)। তুমি নাম দিয়াছ ছিরু পাল (পঞ্চগ্রাম, গণদেবতা)।’’ পল্লীসমাজের বেণী ঘোষালের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা লাভের পরে এই সুবিধাবাদী এবং সুবিধাভোগী শ্রেণি যে রাজনৈতিক দলগুলিতেও প্রবেশ করেছে, সেকথাও বলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘গোবিন্দ গাঙ্গুলী এবং ছিরু পাল — লাগ্ ফাঁস — বাংলাদেশের বাম-দক্ষিণ-স্বাধীন-স্বতন্ত্র সব দলের মধ্যে কিলবিল করিতেছে।’’
বেশ কিছু চিঠিতে উঠে এসেছে ১৯৬৩ ও তার পরবর্তী সময়ের তীব্র খাদ্য সংকটের কথা। এই প্রসঙ্গে সে সময়ের খাদ্যসংকটের অন্যতম মূল কারণ যে হাজার হাজার বিঘা পতিত জমি, সেকথা উল্লেখ করেছেন তারাশঙ্কর। আবার এই পতিত জমির অধিকাংশই যে প্রাক্তন জমিদার বা বড় বড় জোতদারদের বেনামিতে থাকা জমি, সে-ও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন, ‘‘তাঁর হাজার বিঘা জমি। নিজের নামে একশো বিঘা, চার ছেলের নামে একশো বিঘা হিসেবে চারশো বিঘা ; ঘরে গোপাল বা গোবিন্দ বিগ্রহ আছেন — তাঁর নামে একশো বিঘা, বিশ্বস্ত কর্মচারী চার জনের নামে পঞ্চাশ বিঘা হিসাবে দুশো বিঘা। ঘরে বিধবা নিঃসন্তান ভগ্নী আছে, দুই নাতি আছে —তাদের
নামে বাকিটা।’’
১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার পর সারা রাজ্য জুড়ে যে বেনামী জমি উদ্ধার আন্দোলন শুরু হয়, তার পশ্চাৎপটের খোঁজ পাওয়া যাবে এই সব চিঠির কয়েকটিতে। গ্রামের সমাজব্যবস্থাই শুধু নয়, তার কৃষি ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শোষণের স্বরূপ সবই ছিল তারাশঙ্করের নখদর্পণে। বহু চিঠিতে উঠে এসেছে সেসব কথা।
লেখা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে এসেছে দুর্গাপুজো। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রাচীন দুর্গাপুজোর হিসেব দিয়েছেন, এ কালে তার খরচের কথা টেনেছেন, সঙ্গে এসেছে জিনিসপত্রের দরদামের কথা। আবার ভাদ্র মাসের আবহাওয়ার কথা বলতে বলতে কখন যেন ঢুকে পড়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথায়। গ্রামের বিভিন্ন পালা-পার্বণ, প্রথার কথা তিনি বলেছেন বহু চিঠিতে। এ সব কথা বলতে গিয়ে গ্রামে প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন, বিভিন্ন গ্রাম্য শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।এ-সব চিঠিতে তাঁর ভূমিকা শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদকের নয়। এখানে কথাকার তারাশঙ্কর আর সাংবাদিক তারাশঙ্করের কলম যেন বারবার লুকোচুরি খেলেছে।
সেই সময়ে ঘটা পূর্ব-পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, উদ্বাস্তু সমস্যা, নেহরুর মৃত্যু, তীব্র খাদ্য সংকট, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সবই তাঁর চিঠির বিষয়। কিন্তু, অধিকাংশ চিঠিতে তাঁর কলমের বর্শামুখ উদ্যত দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেখানে তিনি নিজের দল কংগ্রেসকে বা কংগ্রেসিদের রেয়াত করেননি। সামগ্ৰিক ভাবে রাজ্য বা ভারতবর্ষের দুর্নীতির সমস্যা নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন, তেমনই একটি পুরো চিঠি জুড়ে দেখতে পাই, স্থানীয় একটি স্কুলের দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা। চিঠিতে স্কুলের নাম বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কংগ্রেস নেতাদের নাম তিনি প্রকাশ্যেই উল্লেখ করেছেন।
স্বাধীনতা লাভের পরে দুর্নীতির চরম বাড়বাড়ন্ত তারাশঙ্করকে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু দুর্নীতির মধ্যেও যখন স্বল্পসংখ্যক ‘নবযুগের তরুণ’দের মাঝে আলোর সন্ধান পেয়েছেন, আশায় দীপ্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘আমি দেখলাম, দুর্নীতির অন্ধকারের মধ্যে নীতির আলোও জ্বলছে। ... মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে বলব, এই প্রদীপ, নতুন প্রদীপগুলিকে সন্ধান করুন। তাদের শিখামুখের সলতে উসকে দিন। তাতে তেল যোগান দিন।’’
১৯৬৫ সালের অগস্টে লেখা তাঁর একটি চিঠির শেষাংশেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন এমন একজন মানুষের আগমনের, যিনি নেতৃত্ব দেবেন গ্রামবাংলার কৃষক এবং দরিদ্র অনশনক্লিষ্ট মানুষকে। লিখেছেন—‘‘একটি মানুষ, সর্বত্যাগী মানুষ, সত্যধর্মে বিশ্বাসী, অর্ধগৃহী অর্ধসন্ন্যাসী, মৃত্যুভয়ে যে ভীত নয়, কোন দলের নেতৃত্ব যার কাম্য নয়— অথচ সে নিজে থাকবে সকলের পুরোভাগে—তিনি ডাক দিলেই এরা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে।’’
(লেখক সাহিত্যকর্মী ও প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy