বাঙালির আইকন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষে তাঁরই গাওয়া একটি গান কয়েক দিন ধরে মগজে খুব ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক বছর আগে বাংলা ছবি ‘হারমোনিয়াম’-এ তিনি গেয়েছিলেন, ‘মন বলে আমি মনের কথা জানি না।’ কয়েকটি সরল শব্দে বড় গভীর এক তত্ত্ব। সত্যিই, নিজের মনকে নিজেই কি সব সময় বোঝা যায়! অন্যের মন হলে তো আরও দুরূহ। কিছু আভাস, কিছু অনুমান তখন মূল ভরসা।
এখন যা হচ্ছে বাঙালির গর্বের আর এক আইকন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে। সৌরভের রাজনীতিতে আসা, বিজেপি-তে যোগ দেওয়া, আগামী নির্বাচনে ওই দলের ‘মুখ’ হয়ে ওঠা এবং বিজেপি জিতলে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসা— সব গুঞ্জন মিলিয়ে খেলার মাঠের দাদা এখন রাজনীতির ময়দানেও জোরদার আলোচনার বৃত্তে ঢুকে পড়েছেন। আর তিনি সৌরভ বলেই বিষয়টি সবার নজর টানছে।
কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। সহসা বলবেন বলেও মনে হয় না। তবে কোনও গুঞ্জন ক্রমশ অর্থবহ হয়ে ওঠার পিছনে অবশ্যই কিছু কার্যকারণ থাকে। এই ক্ষেত্রেও আছে। বিশেষ করে সৌরভের এ বারের জন্মদিনে দু’টি পৃথক ঘটনা তাতে কিছু ইন্ধন জুগিয়েছে। একটির কেন্দ্রে সৌরভের স্ত্রী ডোনা। অন্যটিতে অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতা অরবিন্দ মেনন।
অনেকেই জানেন, ডোনা সে দিন বলে দিয়েছেন, সৌরভ রাজনীতিতে যোগ দিলে শীর্ষস্থানেই থাকবেন। আর সৌরভকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে রঙিন পোস্টার-সহ টুইট করে রাজ্য বিজেপি-তে কেন্দ্র থেকে আসা প্রভাবশালী সহ পর্যবেক্ষক অরবিন্দ দেশের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সম্পর্কে বলেছেন, সৌরভ তাঁর টিমকে ‘লড়াই’ করতে শিখিয়েছিলেন।
ডোনা সৌরভের সবচেয়ে কাছের জন। তাঁর পর্যবেক্ষণ ফেলনা নয়! একই ভাবে সৌরভকে নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যেই সহসা বিজেপি-র অরবিন্দ মেনন যে কায়দায় তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তা-ও তৎপর্যপূর্ণ। আরও লক্ষণীয় হল, ডোনা এবং অরবিন্দ দু’জনের বক্তব্যেই সৌরভের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এবং শীর্ষ দায়িত্বে বসার যোগ্যতা প্রশংসিত হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গড়াবে, সেটা বলার সময় আজ আসেনি। কিন্তু ব্যাপারটি ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার স্তরেও হয়তো আর নেই। তাই পদ্মের পাপড়ি খোলার মতো এক এক করে এই গুঞ্জনের নানা দিক খতিয়ে দেখার সুযোগ অবশ্যই আছে।
সৌরভের সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে। সেই আবেগের জাত-ধর্ম-রং-রাজনীতি নেই। বস্তুত বঙ্গজনেরা রাজনীতিক ‘দিদি’কে নিয়ে বিভক্ত হলেও ক্রীড়াঙ্গনের ‘দাদা’কে নিয়ে এখনও ব্যাপারটা তেমন নয়। সৌরভও সচেতন ভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতির ‘ছোঁয়াচ’ বাঁচিয়ে তাঁর নিজস্ব অবস্থানটি বজায় রেখে চলেছেন, অন্তত এত দিন। সিপিএমের রাজত্বে তৎকালীন শাসকেরা তাঁকে টেনেছিলেন। তিনি জলে নেমেও চুল ভেজাননি। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় বসার পরে তাঁরও ‘কাছের’ হয়ে উঠতে সৌরভের অসুবিধা হয়নি।
তবে গত অক্টোবরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্বে আসার সময় থেকে বিজেপি-র শীর্ষস্তরে, মূলত অমিত শাহের সঙ্গে সৌরভের যোগাযোগ বেড়েছে। এই বোর্ডের সচিব অমিত শাহের ছেলে জয়। সভাপতি এবং সচিবের মধ্যে সম্পর্কও যথেষ্ট মধুর, যা এ ক্ষেত্রে মনে রাখার। বিশ্বখ্যাত বাঙালি ক্রিকেট তারকার স্বচ্ছ ভাবমূর্তিতে আস্থা রেখেই সৌরভের দায়িত্বের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে।
এ হেন পরিস্থিতিতে রাজ্যে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের দৌড়ে নামা বিজেপি-র ‘মুখ’ হিসাবে সৌরভের নাম ভেসে ওঠা একেবারে কাকতালীয় বলতে মন চায় না। বস্তুত বেশ কয়েক মাস আগে এক বার মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠমহলে শুনেছিলাম, সৌরভের নাম সামনে এলে আশ্চর্যের হবে না। আজ বোঝা যাচ্ছে, কথাটি অমূলক ছিল না।
প্রশ্ন, নামটি ছড়াল কেন? এটা কি কোনও পরিকল্পিত রাজনৈতিক ছক অনুযায়ী ভাসিয়ে তোলা? কোনও মহলের নিছক উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা? না কি এর পিছনে আরও কোনও গভীর উদ্দেশ্য কাজ করছে? আবার বলছি, উত্তর পেতে আভাস এবং অনুমানই আপাতত ভরসা।
তবে তার আগে বিজেপি-র অন্দরমহলে একটু উঁকি দেওয়া যাক। রাজ্যে দলের ছাপমারা লোকেদের বাইরে গিয়ে অন্য মুখ খুঁজে নেওয়ার একটি ভাবনা বিজেপি-র উপরতলায় কাজ করছে। সে কথা এখন মোটামুটি চাউর হয়ে গিয়েছে। এর একটি বড় কারণ নিশ্চয় ভাবমূর্তি। দল এখনও ক্ষমতায় আসেনি। তার আগেই স্বচ্ছতা, শালীনতা, আচার-আচরণ, কথাবার্তা ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিজেপি-র পরিচিত অনেক নেতা সম্পর্কে জনমনে বহু প্রশ্ন ও ক্ষোভ জন্মেছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আশঙ্কা, তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ওই সব মুখ দলের পক্ষে ব্যুমেরাং হতে পারে! পাশাপাশি রাজ্য দলে গোষ্ঠী-কোঁদলও বড় কম নয়। কাঁকড়ার মতো একে অপরকে টেনে নামানোর খেলা নিরন্তর চলে এখানে। ইদানীং মাঝেমধ্যে তা বেরিয়েও পড়ছে। ফলে মোদীর জোরে লোকসভায় কিছু বেশি আসন পাওয়ার থেকে রাজ্যের নির্বাচনে জেতার লড়াই যে অধিকতর কঠিন, উপরতলায় নেতারা সেটা বোঝেন।
তাই তাঁদের হয়তো মনে হচ্ছে, আপাত ভাবে অরাজনৈতিক ও স্বচ্ছ কোনও ব্যক্তিত্বকে ‘মুখ’ হিসাবে তুলে ধরা গেলে এক চালে অনেকগুলি কিস্তিমাত করা সহজ হতে পারে। সেই মুখ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কোনও তারকার হোক, বা মঠ-মিশনের কোনও গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর। মূল ভাবনা তাতে বিশেষ বদলায় না। সূত্রের খবর, বিজেপি-র মহলে সৌরভের মতোই এক জন সাধুর নাম নিয়েও নাকি এমন চর্চা জারি আছে। যদিও তা তুলনায় স্তিমিত।
মাঠের সৌরভ বা মঠের সন্ন্যাসী কে কী করবেন, বিজেপি-র এই সব কৌশল আদৌ দানা বাঁধবে কি না, অবশ্যই তা পরের কথা। তবে এর থেকে একটি জিনিস মোটামুটি স্পষ্ট হয়। রাজ্যে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলটির চেনা মুখগুলির উপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কত দূর থাকতে পারে, তা নিয়ে বিজেপি-র উপরতলাই সম্ভবত সংশয়ী। নইলে এমন গুঞ্জনের হাওয়াটুকও উঠত বলে মনে হয় না।
ভোটের আগে দলে নেতৃত্বের প্রশ্নে জটিলতা এড়াতে একটি চালু বয়ান হল, ও সব যথাসময়ে ঠিক হবে! বিজেপি এখন সেই কথা বলছে। কিন্তু এটা আসলে ভাবের ঘরে চুরি! একটি দল বা জোট যখন ভোটে যায়, বিশেষ করে ক্ষমতার দৌড়ে থাকে, তখন কে তার নেতা হবেন অর্থাৎ, দল বা জোট জিতলে কে হবেন মুখ্যমন্ত্রী, সে কথা মানুষ জানতে আগ্রহী হবেই। আর যদি প্রশ্নটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়, তা হলে বলতেই হবে, এ হল নিজেদের দুর্বলতা ও ভিতরের টানাপড়েন চাপা দেওয়ার অপকৌশল। রাজ্যে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা তারও অনেক আগে প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে মমতা পর্যন্ত সকলেই নিশ্চিত ভাবে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রীর মুখ ছিলেন। কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় সেখানে ছিল না। হঠাৎ বিজেপি-র এত ধোঁয়াশা তাই প্রশ্ন জাগায়। কেউ একে জল মাপাও ভাবতে পারেন।
তর্কের খাতিরে নাহয় ধরে নেওয়া যাক, সৌরভ রাজি হলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, নেতৃত্বদানে স্বাভাবিক দক্ষতা ইত্যাদি কিছু বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। আর বাংলায় রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে থাকা এক জনকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসাবে তুলে ধরাও হবে এই প্রথম। তবে পাশাপাশি এটাও প্রমাণ হয়ে যাবে, বিজেপি-র নিজের ঘরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মতো লোক নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy