Advertisement
E-Paper

‘‘তোমার দ্বারা হবে না’’, এই মন্তব্য এসেছে শিক্ষকদের থেকেই

স্বাধীনতার এত বছর পরেও কোনও ক্ষেত্রেই আদিবাসীদের সমস্যার মৌলিক সুরাহা হয়নি। এই চরম প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যেও লড়াইয়ে শামিল আদিবাসী সমাজের মহিলারা। সোনাঝরিয়া মিনজ, স্বাধীন ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্য হলেন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও কোনও ক্ষেত্রেই আদিবাসীদের সমস্যার মৌলিক সুরাহা হয়নি। এই চরম প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যেও লড়াইয়ে শামিল আদিবাসী সমাজের মহিলারা। সোনাঝরিয়া মিনজ, স্বাধীন ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্য হলেন। লিখলেন দীপক সাহা

সোনাঝরিয়া মিনজ।

সোনাঝরিয়া মিনজ।

দীপক সাহা

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২০ ০৩:২৮
Share
Save

বৃহস্পতিবার ২৮ মে, ২০২০।

স্বাধীন ভারতে এক নতুন ইতিহাস সূচিত হল। জাতি, বর্ণের বেড়া ভেঙে স্বাধীন ভারতে এই প্রথম কোনও আদিবাসী মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। ঝাড়খণ্ডের সিধো-কানহো মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হলেন জেএনইউয়ের অধ্যাপক সোনাঝরিয়া মিনজ। ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল দ্রৌপদী মুর্মু নিজেও একজন আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি, তিনিই সোনাঝরিয়াকে নিয়োগ করেন এই গুরুত্বপূর্ণ পদে। অধ্যাপক মিনজ জেএনইউয়ের স্কুল অফ কম্পিউটার এবং সিস্টেমস সায়েন্সের অধ্যাপক ছিলেন। করোনা আবহের মধ্যেই সমগ্র ঝাড়খণ্ড আনন্দে মেতে উঠেছে, যখন তাদের ঘরের মেয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু এই সাফল্যের পিছনে লুকিয়ে আছে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের, লাঞ্ছনা-যন্ত্রণার করুণ কাহিনি।

সোনাঝরিয়া মিনজের স্কুল-পর্ব ছিল রাঁচিতেই। সেখান থেকেই শুরু যুদ্ধ ও সঙ্কল্প। বহু বার শুনেছেন, “তোমার দ্বারা হবে না।” এই মন্তব্য এসেছে শিক্ষকদের থেকেই। তবে এর কারণ এমনটা নয় যে, পড়াশোনায় খারাপ ছিলেন সোনাঝরিয়া। এই মন্তব্যের কারণ ছিল এক ও একমাত্র তাঁর আদিবাসী পরিচয়। এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি অনর্গল দক্ষতার খামতি। তখন থেকেই সোনাঝরিয়ো ঠিক করে নিয়েছিলেন, হার মানবেন না। পড়াশোনা করেই দেখিয়ে দেবেন, তিনিও পারেন। তাঁরাও পারেন। অনর্গল ইংরেজি বলতে পারাটা কেবলই অভ্যাসজাত দক্ষতা, তার বেশি কিছু নয়। এই জেদ এবং মেধার জোর প্রতিফলিত হয় রেজাল্টে। স্কুলজীবনের পরে ভাল রেজাল্ট নিয়ে চেন্নাই চলে যান তিনি। সেখানকার মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে স্নাতক পর্ব শেষ করেন। তার পরে গণিতে এমএসসি করেন সেখানেই। এর পরে এমফিল ও পিএইচডি করেন নয়াদিল্লির জেএনইউ থেকে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। তার পরে সেখানেই কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সদস্যা ছিলেন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েই সক্রিয় ভাবে সরব হয়েছিলেন একাধিক প্রতিবাদে। এরই মধ্যে তিনি অনর্গল ইংরেজি বলতে শিখে নিয়েছেন— এক সময়ে যার জন্য তিনি বিদ্রুপের শিকার হয়েছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার দিল্লি থেকে ঝাড়খণ্ড পৌঁছন অধ্যাপক মিনজ। দায়িত্ব নেন উপাচার্য হিসেবে। অনুচ্চারেই যেন বলা হয়ে যায়, “আমার দ্বারা সব হবে।’’ একই সঙ্গে তিনি আরও একবার প্রমাণ করে যান, ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত বা ভাষা কিছুই মানুষের চরম ইচ্ছেশক্তিকে পরাজিত করতে পারে না। ওঁরাওঁ উপজাতি সম্প্রদায়ের সোনাঝরিয়া মিনজের গর্বিত পিতা লুথেরান বিশপ এমেরিটা নির্মল মিনজ ছিলেন এক জন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি রাঁচির গসনার কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি আদিবাসী সমাজের ভাষাশিক্ষক ছিলেন। ওঁরাওঁ উপজাতির কুদুখ সম্প্রদায়ের ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখায় ২০১৬ সালে ভাষা সম্মানও জয় করেছিলেন তিনি।

ভারতে যখন আর্যদের আগমন হয়, তখন ভারতের আদিম অধিবাসীরা প্রান্তিক মানুষ হয়ে পড়েন। তার পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, কিন্তু আদিবাসীদের শোষণের চিত্রটা বদলায়নি। আজও আমাদের দেশের বহু অঞ্চলে হরিজনেরা সংবিধান লিখিত ‘মৌলিক অধিকার’ থেকে বঞ্চিত। সেই আদিবাসী গোষ্ঠী থেকেই উঠে এসেছেন সোনাঝরিয়া। সংগ্রামের ইতিহাসের পথ কণ্টকাকীর্ণ। সূচনালগ্ন থেকে আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত সমাজে উচ্চশ্রেণির বর্ণহিন্দু যতখানি স্থান লাভ করেছে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণি হয়েছে বঞ্চিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত। সমাজতত্ত্বের রীতি অনুযায়ী এই তাদের অমোঘ ললাট লিখন। ভারতীয় সভ্যতা, যে সভ্যতার গর্বে আমরা ভারতবাসী বলে আহ্লাদিত হই, তা মূলত আর্য সভ্যতার ধারক ও বাহক। ভারতীয় ইতিহাসের মূলধারাটিই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে আর্য সংস্কৃতির দ্বারা। সুতরাং, বহিরাগত বিজয়ী আর্যজাতিই ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। আর ভারতের আদি বাসিন্দা অনার্য সম্প্রদায় বিজিত জাতি হয়ে থেকে গিয়েছে আর্য সমাজের পশ্চাৎদেশে। আর্য সংস্কৃতির মানুষ তাদের কোনও দিন জানতে চায়নি। অনার্য সংস্কৃতির মানুষদের ‘মানুষ’ বলে মানতেও তারা হয়েছে কুণ্ঠিত।

চলমান ইতিহাসের স্রোতধারায় আর্য-অনার্য যত বার শীতল সমরে ব্রতী হয়েছে, অনার্য হয়েছে পরাজিত। তার ঠাঁই হয়েছে অরণ্যে। সভ্যতার সকল প্রকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-বিলাস-ব্যসন থেকে তারা হয়েছে বঞ্চিত। কিন্তু অযুত সমস্যার মধ্যেও তারা তাদের সংস্কৃতিকে মরতে দেয়নি। আর্য পরিমণ্ডল থেকে দূরে অবস্থান করেও তারা নিজস্ব সমাজের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বহন করে চলেছে তাদের প্রিয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের কয়েক দশক পরেও স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র ভারতে অনার্য সম্প্রদায়ের খুব বেশি অবস্থান্তর হয়নি। সরকারি দাক্ষিণ্যে তারা তফশিলভুক্ত উপজাতি সম্প্রদায়ের সম্মান লাভ করেছে। ভারতের বহুজন সমর্থিত গ্রন্থিত ইতিহাসে তাই অনার্য জাতির কথা সহজলভ্য নয়।

স্বীকৃত ইতিহাস যেখানে কোনও জনগোষ্ঠীকে অস্বীকার করে তখন সমাজে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও যে সেই জাতি খুব বেশি স্থান পাবে না, তা সহজবোধ্য। মহাশ্বেতা দেবীর কথায়— ‘‘আদিবাসীদের মধ্যে সব আছে, পাহাড়ের ধৈর্য, নদীর শান্তি। প্রতি আদিবাসী যেন এক মহাদেশ। কিন্তু আমরা তো তাদের জানতে চাইনি।’’ জানতে না চাওয়ার কারণই হল আমাদের জাত্যাভিমান, উন্নাসিক মানসিকতা।

ভারতের সর্বশেষ জনগণনার তথ্যানুযায়ী দেশের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় এক ষষ্ঠাংশ আদিবাসী। ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, কোল, ভিল, লোধা, খেড়িয়া, শবর, মাহালি, গোঁড়, বিরহড়, গঞ্জু, হো, টোটো, পুটয়া, চিত্রকর ইত্যাদি বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে আছে ভারতের প্রায় সব প্রদেশেই। আর্য সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকেরা আদিবাসী সমাজকে কেবল শোষণ, শাসন, পীড়নই করে গিয়েছে। তাই স্বাধীনতার এতগুলি বছর পেরিয়েও খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা, সামাজিক পরিকাঠামো, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা কোনও ক্ষেত্রেই আদিবাসীদের সমস্যার মৌলিক সুরাহা হয়নি।

এই চরম প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যেও লড়াইয়ে শামিল আদিবাসী সমাজের মহিলারা। গোটা দেশজুড়ে কোনও কিছুতেই পিছিয়ে নেই। তাঁরা পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। উল্লেখ্য, আমাদের রাজ্যেও ইতিমধ্যে সাঁওতালি ভাষায় নেট উত্তীর্ণ বেশ কয়েক জন আদিবাসী মহিলা রয়েছেন। তাঁরাই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র আদিবাসী সমাজের তথা আদিবাসী মহিলাদের মাইলফলক হয়ে দাঁড়াবেন। খেলাধুলোয় তো বটেই, রেডিয়ো জকি হিসাবেও সুনাম অর্জন করেছেন বাংলার শিখা মান্ডি। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসছেন আদিবাসী মহিলারা। এই তো গেল বছর সেপ্টেম্বর মাসে আকাশ ছুঁল প্রথম আদিবাসী কন্যা অনুপ্রিয়া মধুমিতা লাকরা। ওড়িশার মালকানগিরি। মাওবাদি অধ্যুষিত এই এলাকায় যেখানে বাসিন্দাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেই এলাকার মেয়ে পাইলট হয়েছেন। প্রশাসনিক গুরুভার সামলাচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের দ্রৌপদী মুর্মু।

এই সব ইতিহাসে আরও একটি সোনার পালক যোগ হল সোনাঝরিয়া মিনজের কৃতিত্বে। এক নতুন দিগন্তের সূচনা হল। তবে সুদীর্ঘ পথ চলা এখনও বাকি।

লেখক শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক

Sonajharia Minz Education

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}