প্রতীকী ছবি।
চিকিৎসক, নিজেকে নীরোগ করো। প্রচলিত অনুজ্ঞাটির অনুসরণে বলা চলে, ‘শিক্ষক, নিজেকে শিক্ষিত করুন।’ বিদ্যার্থীর পিতৃপরিচয় দাবি করা অন্যায়— ইহা মানেন না এই রাজ্যের শিক্ষকদের একাংশ। তাঁহারা আজও পিতৃপরিচয়কে বিদ্যালাভের শর্ত করিতেছেন।
স্কুল-কলেজে ভর্তির তথ্যপত্রে পিতার পরিচয়ের স্থান শূন্য রাখিলে যদি তাহা যান্ত্রিক নিয়মে বর্জিত হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে ওই প্রতিষ্ঠান পুরুষতন্ত্র-নির্মিত প্রাচীন যন্ত্রমাত্র। সংবিধান হইতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, কিছুই তাহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নাই। সেই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাঁহারা কর্ণধার, তাঁহাদের চক্ষুকর্ণ নাই, তাই পারিপার্শ্বিক জগতের পরিবর্তন তাঁহারা প্রত্যক্ষ করিতে পারেন না। মস্তিষ্ক নাই, তাই নারী-স্বাতন্ত্র্যের যুক্তি বা দৃষ্টান্ত বিবেচনা করিতে অক্ষম। হৃদয় নাই, তাই মা ও সন্তানের অবমাননা তাঁহাদের স্পর্শ করে না। সংক্ষেপে, তাঁহারা শিক্ষক হইবার অনুপযুক্ত। কিন্তু সরকার ও সমাজ তাঁহাদের গোটাকতক পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট, এবং প্রতিষ্ঠান চালাইবার লাইসেন্স দিয়াছে। শিক্ষার কারবার আটকাইবার সাধ্য কাহার? সন্তানের পূর্ণ অভিভাবকত্ব তাহার জননীর উপর ন্যস্ত করিতে যদি আইন এবং আদালত সম্মত থাকে, তবে অধ্যক্ষের আপত্তি কেন? ভুলিবেন না, যে সকল স্কুল-কলেজ সরকারি অনুদানের অন্তর্ভুক্ত নহে, সেগুলিও সরকারি অনুশাসনের অধীন।
প্রতিষ্ঠান সরকারি হউক বা বেসরকারি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হউক অথবা সামরিক বাহিনীর দ্বারা, শিক্ষার অধিকার আইন মানিতেই হইবে। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম দেশের আইন লঙ্ঘন করিতে পারে না। মাতার একক অভিভাবকত্ব এ দেশে স্বীকৃত। একক মহিলা সন্তান দত্তক লইতে পারেন, কৃত্রিম প্রজননের সাহায্যে গর্ভধারণ করিয়া সন্তানের জন্মও দিতে পারেন। আইন আজ উদার, কিন্তু সমাজ আজও একক মাতা ও তাঁহার সন্তানকে ব্রাত্য করিতে সচেষ্ট। একক মাতার প্রতি এই অসহিষ্ণুতা স্কুল-কলেজেই সীমাবদ্ধ নাই। প্রায় যে কোনও সরকারি পরিচয়পত্রের জন্য তথ্য লইবার সময়ে কর্তৃপক্ষ পিতার পরিচয়ের প্রশ্ন নিয়মিত তুলিয়া থাকে। এই অধিকার কাহারও নাই। মাতা বিবাহিত হউন অথবা অবিবাহিত, সন্তানের উপর তাঁহার অধিকার, অভিভাবক হিসাবে তাঁহার মর্যাদা, সকল ক্ষেত্রেই সমান। সন্তানের পূর্ণ দায়িত্ব মাতা গ্রহণ করিয়াছেন কি না, সেই তথ্যই কর্তৃপক্ষের জন্য যথেষ্ট।
স্কুল-কলেজ কখনও উদ্বেগ প্রকাশ করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুর ‘কল্যাণ’ লইয়া, কখনও অভিভাবকত্ব-সংক্রান্ত আইনে জটিলতা দেখা দিবার আশঙ্কা প্রকাশ করে। বাস্তব সম্ভবত ভিন্ন। রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্র মেয়েদের যৌনজীবন এবং সন্তানধারণকে কেবল বিবাহ এবং দাম্পত্যের মধ্যে দেখিতেই অভ্যস্ত। একক মাতৃত্ব তাহার নিকট প্রবল অস্বস্তির কারণ। অস্বস্তি বস্তুত সন্তানের পিতৃহীনতা লইয়া নহে। তাহা মাতার অভিভাবকহীনতা। কোনও পুরুষের তত্ত্বাবধানে না থাকিয়াই যে এক নারী নিজের সন্তানের তত্ত্বাবধান করিতেছেন, ইহাকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া মানিতে বড়ই আপত্তি। নারীর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তাকে দেশের সংবিধান, আইন, সুপ্রিম কোর্ট মান্যতা দিতে পারে। তা বলিয়া আত্মীয়-প্রতিবেশী বিনা প্রশ্নে মানিবে? পুলিশ-প্রশাসন মানিবে? সর্বোপরি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক কি তাহা মানিবেন? কঠিন পরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy