এমন কিছু দরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যাদের নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে না দিলে গণতন্ত্রের মান ধরে রাখা যায় না। এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে অনায়াসে গণতন্ত্রের চৌকিদার বলা চলে। ‘চৌকিদার’ কথাটা অবশ্য ইদানীং রাজনৈতিক তর্জায় ব্যবহৃত হতে হতে একেবারে ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক তর্জার প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, তার আগে প্রতিষ্ঠানের কথা বলি। প্রশ্ন হল, গণতন্ত্র ঠিকঠাক চালাতে গেলে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান কেন দরকার?
আমাদের দেশে বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে, একটা রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসে। সেই নির্দিষ্ট সময়টা পেরিয়ে গেলে ক্ষমতাসীন দলকে আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয়, মানুষের কাছে নিজেদের কাজকর্মের পরীক্ষা দিতে হয়। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। এর ফলে, প্রত্যেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ওপর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিছু কাজ করে দেখানোর চাপ থাকে। নির্বাচিত থাকার সময় তিনি কী কী করলেন তার একটা বিশ্বাসযোগ্য তালিকা পরবর্তী নির্বাচনের আগে মানুষের সামনে তাঁকে খাড়া করতেই হয়। অন্য ভাবে বলতে গেলে, এক জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ভাবনা বা পরিকল্পনার পরিধিটা মূলত স্বল্পমেয়াদি। দেশের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত বা বিলাসিতা প্রায়শই তাঁর থাকে না।
এটা গণতন্ত্রের একটা মৌলিক সমস্যা। কারণ, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দেশের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ আর দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের মধ্যে সংঘাত রয়েছে। দেখা যায়, একটা নীতি সাময়িক ভাবে কিছু সমস্যার সমাধান করলেও পরে পাকাপাকি ভাবে সেটা দেশের ক্ষতি করছে। এক জন জনপ্রতিনিধিকে যদি অনেক দিনের জন্য নির্বাচিত করা যেত তা হলে হয়তো তিনি দেশের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারতেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা অনেক দিনের জন্য নির্বাচিত হলে অন্য সমস্যা দেখা দিত। তখন তাঁদের কাজ করার তাগিদটাই চলে যেত, যে হেতু এক বার নির্বাচনের বৈতরণি পার হয়ে যেতে পারলে তাঁদের চট করে আর জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হত না। তাই চার-পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন হওয়াটা গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জরুরি। আবার স্বল্প দিনের জন্য নির্বাচিত হলে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দূরদৃষ্টিহীনতার সম্ভাবনাটাও থেকে যাচ্ছে।
এই উভয়সঙ্কট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু স্বাধীন, চিরন্তন, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান থাকাটা জরুরি, যেগুলি হবে মোটের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পালাবদল ঘটলেও যাদের চরিত্র পাল্টাবে না। এই প্রতিষ্ঠানগুলিরই দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা করার কথা। দরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাটা ছোট নয়। সামরিক শক্তি, পুলিশ, আইনি ব্যবস্থা, প্রশাসন, ইস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারের তথ্য-পরিসংখ্যান বিভাগ, আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, সবই এই তালিকাভুক্ত। গণতন্ত্রের সাফল্য-অসাফল্য নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই মেনে নেন, উন্নত দেশগুলিতে গণতন্ত্রের প্রহরী এই প্রতিষ্ঠানগুলি তুলনায় সজাগ ও সক্রিয় বলে সে সব দেশে গণতন্ত্রের মানও উন্নত। তুলনায় গরিব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল, তাই সেখানে গণতন্ত্রও নিম্নমানের।
সামরিক শক্তি, পুলিশ, আইনি ব্যবস্থা কিংবা প্রশাসনের নিরপেক্ষ থাকার প্রয়োজনীয়তাটা সকলেই বোঝেন, এ-নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তথ্য-পরিসংখ্যান কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে, সেটা কিছুটা ব্যাখ্যা করে বলা দরকার। বিশেষ করে এই কারণে যে, আমাদের দেশে কিছু দিন ধরেই এই প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ প্রভাব বিস্তার করছে।
গণতন্ত্রের মান একটা কাঙ্ক্ষিত স্তরে পাকাপাকি ভাবে ধরে রাখতে গেলে মুক্ত, সংস্কারহীন ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যাঁরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করবেন, দেশের ভালমন্দ বিষয়ে তাঁদের দূরদৃষ্টি থাকাটা জরুরি, যে দূরদৃষ্টি একটা উদার শিক্ষার বাতাবরণেই তৈরি হতে পারে। আমাদের গরিব দেশে শিক্ষার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, গত চার-পাঁচ বছর যাবৎ শিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ইতিহাস-বিজ্ঞান-অর্থনীতি-দর্শন সব কিছু নিয়েই একটা অশিক্ষা মানুষের মনে চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, বহু দিন আগেই ভারতবর্ষে এরোপ্লেন আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল যে হেতু পুরাকালে রাবণরাজা পুষ্পক রথে চড়ে আকাশপথে ভ্রমণ করতেন। কিংবা বহু যুগ আগেই ভারতবাসীরা প্লাস্টিক সার্জারির বিদ্যা জেনে ফেলেছিলেন যে হেতু শিবের প্রকোপে খসে যাওয়া গণেশের মুণ্ডের জায়গায় শিবেরই প্রসাদে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল হাতির মাথা। এই সব কারও কারও হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা গভীর উদ্বেগের। একটা অশিক্ষা থেকে জন্ম নিচ্ছে আর একটা অশিক্ষা, সঙ্কীর্ণ ধর্মান্ধতা, ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদ। ভারতের ইতিহাস নিয়ে একটা মিথ্যা গরিমা তৈরি হচ্ছে, যার থেকে শাসক দল তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধে পাচ্ছে সন্দেহ নেই, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বিচারে এর ফল প্রকৃতই মারাত্মক।
আমাদের দ্বিতীয় আশঙ্কা সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে। ২০১৫ সালে যখন ২০১১-১২’কে ভিত্তিবর্ষ ধরে জাতীয় আয়ের নতুন সিরিজ় বেরোল, আর দেখা গেল নতুন সিরিজ় অনুযায়ী ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার পুরনো সিরিজ়ের তুলনায় হঠাৎ লাফ দিয়ে অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে, তখন থেকেই সরকারি পরিসংখ্যান তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করেছে। নতুন সিরিজ় নিয়ে তার পর থেকে একটার পর একটা সমস্যা। যেমন, সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজ়েশন (সিএসও) সম্প্রতি জাতীয় আয়ের পরিমার্জিত যে হিসেব বার করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৬-১৭’তে, অর্থাৎ নোট বাতিলের বছরে, জাতীয় আয়বৃদ্ধির হার এক দশকের মধ্যে সব থেকে বেশি। উদ্দেশ্য এটাই বোঝানো যে, নোট বাতিলের ফলে ভারতীয় অর্থনীতির কোনও ক্ষতি হওয়া দূরের কথা, উল্টে বিস্তর উপকার হয়েছে। একই সঙ্গে কোনও পরিসংখ্যান সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে চেপে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের ২০১৭-১৮ সালের জাতীয় কর্মসংস্থান সমীক্ষার রিপোর্ট। এই ধরনের সমীক্ষা এর আগে হয়েছিল ২০১১-১২ সালে। সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়া খবরে প্রকাশ, ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০১১-১২’র তুলনায় ২০১৭-১৮’তে বেকারদের সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ভোটের ঠিক আগে এই ধরনের তথ্য প্রকাশিত হলে ক্ষমতাসীন দল স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়বে। তাই এই রিপোর্টটি প্রকাশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, যদিও জাতীয় স্ট্যাটিস্টিকাল কমিশন আগেই এটি প্রকাশের ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিল। সরকারি পরিসংখ্যানের অপস্রিয়মাণ বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিবাদে সম্প্রতি ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ, সংখ্যাতত্ত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। এর উত্তরে সরকার পক্ষের ১৩১ জন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সই দিয়ে জানিয়েছেন সরকারি পরিসংখ্যানে কোনও গলদ নেই, অর্থনীতিবিদদের বিবৃতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভয় হয়, অচিরেই হয়তো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের দিয়ে অর্থনীতি, সংখ্যাতত্ত্ব বা সমাজবিজ্ঞান পড়ানো হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতায় সরকারি হস্তক্ষেপের আর একটা উদাহরণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। সরকার চেয়েছিল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তার ঋণনীতি শিথিল করুক, অনাদায়ী ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া ব্যাঙ্কগুলির প্রতি আরও নরম মনোভাব দেখাক, তাদের আয়ের একটা বড় অংশ সরকারকে দিয়ে দিক, যাতে নির্বাচনের আগে অর্থনীতিটা চাঙ্গা হয় আর সরকারের হাতেও কিছু পয়সা আসে। দীর্ঘমেয়াদি কুফলের কথা ভেবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এর কোনওটাই করতে চায়নি। কিন্তু আমরা জানি, সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হার হয়েছে, সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দখল নিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাজকর্মে সরকারি হস্তক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদি ফল যে ভাল হয় না সেটা তো নানা দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আগেই জানা ছিল।
গণতন্ত্রে একটা নির্বাচিত সরকারের হাতে অসীম ক্ষমতা থাকে, সে চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলো করতে নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থেই করতে নেই। জানি না, বর্তমান সরকার সে কথা বোঝে কি না। নির্বাচনের মরসুমে চৌকিদার চোর না সাধু, তা নিয়ে খুব তর্জা চলছে। আমরা সে তর্জায় ঢুকব না। শুধু ক্ষমতাধারীদের কাছে করজোড়ে অনুরোধ করব, চৌকিদারের ওপর চৌকিদারি করা যে প্রতিষ্ঠানগুলির মৌলিক দায়িত্ব, দয়া করে তাদের নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে দিন।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy