নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
সুবিশাল জনগোষ্ঠী। বৈচিত্রে অসমান্তরাল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। রাজনৈতিক স্বৈরাচারের তথা ঔদ্ধত্যের অভিযোগ মাথায় নিয়ে বেশি দিন অজেয় থাকা কঠিন এ দেশে। দেশজোড়া উপনির্বাচন সে শিক্ষাই সম্ভবত দিল ভারতের শাসক দলকে।
উপনির্বাচন হয়েছে ৪টি লোকসভা কেন্দ্রে ও ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রে। দেশের মেজাজ কেমন, এতেই তা বোঝা সম্ভব? দেশের প্রায় সব প্রান্তে এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে যখন নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলো, তখন দেশের মেজাজ বুঝে নেওয়া অনেকটাই সম্ভব। সাধারণ নির্বাচন নয় ঠিকই। কিন্তু সামগ্রিকতার প্রতিনিধিত্বমূলক উপনির্বাচন বলাই যায়। সে নির্বাচনের ফল বলছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ ৪ লোকসভা কেন্দ্রের ২টিতে জয়ী, ২টিতে পরাজিত। আর ১১টি বিধানসভার কেন্দ্রের ১টিতে জয়ী ১০টিতে পরাজিত।
কর্মী-সমর্থকদের কথা আপাতত ছেড়েই দেওয়া যাক। নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহও কি বলতে পারবেন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সম্ভাব্য জয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই ফলাফল? পারবেন না। কেন এমন পরিস্থিতি হল? অত্মসমীক্ষা করা উচিত বিজেপির।
আরও পড়ুন: বন্ধু বাড়াতে না পারলে ২০১৯-এ বিপর্যয় হতে পারে, বার্তা দিল উপনির্বাচন
৩০ বছর পরে কোনও দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। এর আগে ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে শেষ বার কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ে। তার পরে টানা তিন দশক কোনও দলের পক্ষে তা পাওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালে এসে বিজেপি ২৭২-এর জাদুসংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হল। দেশের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে বলে অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিত তথা পর্যবেক্ষক মত প্রকাশ করলেন। খুব অবান্তর মত প্রকাশ করলেন, এমনও নয়। কিন্তু চার বছর কাটতে না কাটতে সে নতুন যুগের নতুন রং যেন ফিকে।
গুরুতর গলদ কিছু ঘটে গিয়েছে নিশ্চয়ই। সেটাই খুঁজে বার করতে হবে বিজেপি-কে। শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের সুসাস্থ্যের জন্যও বিজেপির এই আত্মমন্থন জরুরি।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে সাফল্য বিজেপি অর্জন করেছিল, তা নিঃসন্দেহে নজির সৃষ্টিকারী। তার পরেও একের পর এক রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া যে ভাবে ছুটছিল, তাও অন্য যে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে ঈর্ষনীয়। এ রকম ঈর্ষনীয় সাফল্য পাওয়া অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু সাফল্যের কারণে কারও ঈর্ষা বা বিদ্বেষের পাত্র হয়ে ওঠা রাজনীতিতে অন্তত কোনও কাজের কথা নয়। যত বেশি জনসমর্থন আসছে, মাথা তত বেশি নুয়ে যাবে— গণতন্ত্রে সাফল্য ধরে রাখার মূল মন্ত্র এটাই। কিন্তু বিজেপির ক্ষেত্রে সম্ভবত উল্টোটাই ঘটল। সাফল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দর্প। মাথা নুয়ে এল না, ফুলে উঠল বক্ষস্থল ক্রমশ বরং। অতি দর্পে হতা লঙ্কা— আপ্তবাক্য সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। তিন দশক পরে কোনও একটি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গঠিত সরকারও নড়বড়ে হয়ে গেল অতএব। দীর্ঘ অস্থিরতার যুগ কাটিয়ে স্থায়ী সরকারে ফেরার যে স্বস্তি, ভারতীয় জনগোষ্ঠী তাও বিসর্জন দিতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যের সঙ্গে আপোস না করার বার্তাটা খুব স্পষ্ট করেই দিয়ে দিল।
ঔদ্ধত্যের অভিযোগটা কিন্তু সব তরফ থেকেই উঠছে। বিরোধী দল শুধু নয়, শরিকরাও বলছে, বিজেপি দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। মূলত এই ঔদ্ধত্য বা অবিনয় বা অবহেলার কারণ দেখিয়েই এনডিএ ছেড়ে গিয়েছেন অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নায়ডু। একই কথা বলছেন মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরে প্রায় রোজ এবং অত্যন্ত চড়া স্বরে। বিহারের রামবিলাস পাসোয়ানও ক্ষোভ ব্যক্ত করে রেখেছেন।
জোটসঙ্গী কি কোথাও নেই তা হলে আর বিজেপির? রয়েছে। কিন্তু যে সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক ভাল, সে সঙ্গী জনপরিসরে অপ্রিয়। যেমন পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দল। আর যে সঙ্গী এখনও জনপ্রিয়, তার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন বিস্তর। যেমন বিহারে জেডি(ইউ)।
সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল পরিস্থিতিটা তা হলে? জনসমর্থনের দর্পে ঔদ্ধত্য মাথা চাড়া দিয়েছে বলে অভিযোগ। তার জেরে একের পর এক শরিকের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন। ক্রমশ অগোছালো এনডিএ। আর কোনঠাসা হতে হতে ক্রমশ একজোট বিরোধী শিবির। অবশেষে দেশজোড়া এক উপনির্বাচনে সম্মিলিত-সঙ্ঘবদ্ধ বিরোধী শক্তির সম্মুখীন হল প্রায় নির্বান্ধব হয়ে পড়া শাসক। একের পর এক কেন্দ্র থেকে পরাজয়ের খবর আসতে থাকল।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কী হতে চলেছে, তার অভ্রান্ত পূর্বাভাস দেওয়া এই উপনির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে সম্ভব নয়, উচিতও নয়। কিন্তু এই উপনির্বাচনের ফলাফলে একটা আভাস রয়েছে, সব পক্ষের জন্যই শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। কিছুটা স্বার্থ ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শিবিরের ছবি তুলে ধরা গেলে গেরুয়া পাল থেকে হাওয়া সম্পূর্ণ টেনে নেওয়া অসম্ভব নয়— শিক্ষা বিরোধী দলগুলির জন্য। আত্মসমীক্ষার পথে হেঁটে বিনয়ী হতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব মিত্রবৃদ্ধি ঘটাতে হবে, তাহলেই একমাত্র হাওয়া ফিরে পাওয়া যাবে নিজেদের পালে— শিক্ষা বিজেপির জন্য। কোন পক্ষ কতটা কাজে লাগাতে পারবে এই শিক্ষাকে, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করবে দেশের রাজনৈতিক প্রবাহের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy